**বিদ্যুৎ খাতে গত ১৫ বছরের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করেছে শেয়ার বিজ। এতে দুর্নীতি-অনিয়ম ছাড়াও ভর্তুকি, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির চিত্র উঠে এসেছে। এ খাতের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ নিয়ে আজ থাকছে ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্ব
ইসমাইল আলী : দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা গত ১৫ বছর টানা বেড়েছে। এ সময় সরকারি খাতের চেয়ে বেসরকারি বিনিয়োগ হয়েছে বেশি। পাশাপাশি বিদেশি এবং দেশি-বিদেশি যৌথ বিনিয়োগেও বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ছোট-বড় বিভিন্ন দেশীয় গ্রুপ ও বিদেশি কোম্পানি যুক্ত হয়েছে। তবে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেশিরভাগই কিছু সংখ্যক শিল্পগ্রুপ বা ভারতের হাতে কেন্দ্রীভূত। ফলে দেশের বিদ্যুৎ খাতের বড় অংশই কয়েকটি গ্রুপ ও ভারতের নিয়ন্ত্রণে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিভিন্ন প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এ তথ্য পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, দেশের বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণ সামিট গ্রুপের হাতে। এ গ্রুপের অধীনে বর্তমানে ১৪টি ছোট-বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে ৫৮৯ মেগাওয়াটের দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক (গ্যাস-ডিজেল) মেঘনাঘাট-২ কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র (সিসিপিপি)। সামিটের আরেকটি ৩৩৫ মেগাওয়াট মেঘনাঘাট-১ দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (সিসিপিপি) রয়েছে। আর বিবিয়ানায় রয়েছে সামিটের ৩৪১ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক আরেকটি (সিসিপিপি) বিদ্যুৎকেন্দ্র।
গাজীপুরে রয়েছে সামিটের ফার্নেস অয়েলচালিত দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর মধ্যে কড্ডা-১ কেন্দ্রটির সক্ষমতা ১৪৯ মেগাওয়াট, যা এইস অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত। আর কড্ডা-২ কেন্দ্রটির সক্ষমতা ৩০০ মেগাওয়াট। এছাড়া সামিট বরিশাল ১১০ মেগাওয়াট, সামিট মদনগঞ্জ-১ ৫৫ মেগাওয়াট ও মদনগঞ্জ-২ ১০২ মেগাওয়াট, সামিট পাওয়ার (মাধবদী ও আশুলিয়া) ৮০ মেগাওয়াট, মাওনা ৩৩ মেগাওয়াট, রূপগঞ্জ ৩৩ মেগাওয়াট, জঙ্গলিয়া ৩৩ মেগাওয়াট, কুমিল্লা ২৫ মেগাওয়াট এবং উল্লাপাড়া ১১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র সামিট গ্রুপের।
ভারতের আদানি পাওয়ারের ঝাড়খণ্ডের গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে।
কয়লাভিত্তিক এ কেন্দ্রটি ভারতে নির্মাণ করা হলেও ২৫ বছর এটি থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। সক্ষমতার দিক থেকে দেশের ভেতরে নির্মিত সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা। বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) মালিকানাধীন এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতা এক হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানায় সমান অংশীদার রয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি)।
বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) মালিকানাধীন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বর্তমানে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র। কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতা এক হাজার ২৩৪ মেগাওয়াট। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে বাংলাদেশের পিডিবি ও ভারতের রাষ্ট্রীয় তাপবিদ্যুৎ করপোরেশনের (এনটিপিসি) ৫০ শতাংশ করে শেয়ার রয়েছে। বাংলাদেশের এস আলম গ্রুপ ও চীনের সেপকো থ্রির যৌথ মালিকানাধীন এসএস পাওয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতা এক হাজার ২২৪ মেগাওয়াট। কয়লাভিত্তিক এ কেন্দ্রটি দেশের তৃতীয় বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র।
দেশের এরপর সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে ভারত। দেশটির এনটিপিসির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এনভিভিএন (বিদ্যুৎ ভ্যাপার নিগম লিমিটেড) থেকে তিন ফেজে যথাক্রমে ১৬০, ২৫০ ও ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১৬০ মেগাওয়াট আসে ত্রিপুরা থেকে। এছাড়া সেম্বকর্প ইন্ডিয়া থেকে ২৫০ মেগাওয়াট ও পিটিসি থেকে ২০০ মেগাওয়াট আসে। মোট এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে ভারতের পাঁচটি কেন্দ্র থেকে।
সক্ষমতার দিক থেকে দেশে পরের স্থানে রয়েছে দেশের ইউনাইটেড গ্রুপ। এ গ্রুপের ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৯৮৫ মেগাওয়াট। তবে এ গ্রুপের আরেকটি ৫৯০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে। বর্তমানে ইউনাইটেড গ্রুপের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রটি আনোয়ারায় অবস্থিত। ৩০০ মেগাওয়াটের এ কেন্দ্রটি ফার্নেস অয়েলচালিত। এছাড়া ইউনাইটেড আশুগঞ্জ ১৯৫ মেগাওয়াট, জামালপুর ১১৫ মেগাওয়াট, ময়মনসিংহ ২০০ মেগাওয়াট, পটুয়াখালী ১৫০ মেগাওয়াট এবং শাহজাহানউল্লাহ পাওয়ার ২৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রগুলো ইউনাইটেড গ্রুপের মালিকানাধীন।
ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপ ৭১৮ মেগাওয়াটের এলএনজিচালিত (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। শিগগিরই এটি উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। সক্ষমতার দিক থেকে পরের স্থানে থাকা ওরিয়ন গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ছয়টি, যেগুলোর সক্ষমতা ৬১১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ১০০ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র রয়েছে সৌরবিদ্যুতের। বাকিগুলো সবই ফার্নেস অয়েলচালিত। এর মধ্যে ওরিয়ন রূপসা ১০৫ মেগাওয়াট, সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট, মেঘনাঘাট ১০০ মেগাওয়াট ও ১০৪ মেগাওয়াট এবং গঙ্গাবাজার ১০২ মেগাওয়াট।
ডরিন গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৯টি, যেগুলোর সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা ৬১১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে রয়েছে নরসিংদী ২২ মেগাওয়াট, ফেনী ১১ মেগাওয়াট ও ২২ মেগাওয়াট, টাঙ্গাইল ২২ মেগাওয়াট, নবাবগঞ্জ ৫৫ মেগাওয়াট, মানিকগঞ্জ ৫৫ মেগাওয়াট ও ১৬২ মেগাওয়াট, চাঁদপুর ১১৫ মেগাওয়াট এবং বাঙ্কো এনার্জি ৫৪ মেগাওয়াট। আর ইউনিক গ্রুপের ৫৮৩ মেগাওয়াট সক্ষমতার এলএনজিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্প্রতি উৎপাদন শুরু করেছে।
কনফিডেন্স গ্রুপের পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ৪০৪ মেগাওয়াট। এর মধ্যে রয়েছে হবিগঞ্জ ১১ মেগাওয়াট, বগুড়া ইউনিট-১ ১১৩ মেগাওয়াট ও ইউনিট-২ ১১৩ মেগাওয়াট, রংপুর ১১৩ মেগাওয়াট এবং জয়িডাক পাওয়ার ৫৪ মেগাওয়াট। আর বারাকা গ্রুপের চার বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ৩১৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে রয়েছেÑবারাকা পাওয়ার (বরকতউল্লাহ) ৫৪ মেগাওয়াট, বারাকা পতেঙ্গা ৫০ মেগাওয়াট, শিকলবাহা ১০৫ মেগাওয়াট ও কর্ণফুলী ১১০ মেগাওয়াট।