পতিত সরকারের আমলে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি ছিল ‘গুম’। হাজার হাজার মানুষ গুম হয়েছেন। স্বজনরা গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান চাইলেও সাবেক সরকারপ্রধান নানা অজুহাতে এড়িয়ে গেছেন; বলেছেন, ‘স্বজন হারানোর বেদনা আমার চেয়ে কে বেশি বোঝে!’ পটপরিবর্তনের পর বিচারের দাবি জোরালো করছেন গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা। গুমের সঙ্গে জড়িতদের বিচারও দাবি করেছেন তারা। তারা দীর্ঘদিন ধরেই এই দাবি জানিয়ে আসছেন। গত ৩০ আগস্ট পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস। সেদিনও গুম হওয়া স্বজনদের ফেরত চেয়ে এবং নেপথ্যের কুশীলবদের বিচারের দাবিতে রাজপথে সোচ্চার হয়েছেন স্বজনহারা পরিবারের সদস্যরা।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গুম হওয়া কোনো কোনো ব্যক্তির সন্ধান মিলেছে। অন্তর্বর্তী সরকার গত ২৭ আগস্ট ‘২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট’ পর্যন্ত পুলিশ, র?্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র?্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্টগার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্য কর্তৃক জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের নিমিত্তে তদন্ত কমিশন গঠন করেছে। গতকাল শেয়ার বিজে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কার্যালয় প্রস্তুত নয়, গুমের তদন্তে কাজ শুরু করতে পারেনি কমিশন।’ ফলে এ কমিশনকে তদন্ত শেষ করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে যে ৪৫ কার্যদিবস সময় দেয়া হয়েছে, তা নির্দিষ্ট সময়ে পরিচালন করা সম্ভব নয় বলেই প্রতীয়মান।
মনে রাখতে হবে, বিলম্বিত বিচার মানেই অবিচার। গুমের সামগ্রিক চিত্র এবং এর নেপথ্যের কারিগরদের শনাক্ত করা না গেলে বিচারকাজেও সময়ক্ষেপণ হতে পারে। গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানালেও বিচার পাননি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক মাস পূর্তিতে বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেয়া বার্তায়ও ‘গুম সংস্কৃতির’ সমাপ্তি ঘটানোর অঙ্গীকারের কথা বলা হয়। আয়নাঘর নামে পরিচিতি পাওয়া গোপন বন্দিশালাগুলো বন্ধ করে দেয়ার কথা বলেন তিনি।
গুম মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ। যাদের গুম করা হয়েছে কেবল তাদের ক্ষেত্রেই যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে তা নয়, গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরাও দীর্ঘ সময় ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন। এর সঙ্গে তাদের মানসিক যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে, আর্থ-সামাজিক সংকট মোকাবিলা করতে হয়েছে।
আমরা মনে করি, গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের পাশাপাশি যারা গুমের সঙ্গে জড়িত তাদেরও খুঁজে বের করা দরকার। গুম করার সিদ্ধান্ত কোথা থেকে এসেছে, সেটাও জানতে হবে। গুমের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি ব্যক্তির বিচার নিশ্চিত করতে হবে। আগামীতে গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করার জন্য এটা করা অত্যন্ত জরুরি। দেশে যেন আর কোনো গুমের ঘটনা না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করতে বিচার প্রলম্বিত করার সব শৈথিল্য ও অপচেষ্টা রোধ করতে হবে।