নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি চরম ভারসাম্যহীন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক খাতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ব্যাংক খাতে এখন বেশি সংকট যাচ্ছে। নন-পারফরমিং লোন (এনপিএল) বাড়ছে। ব্যালেন্স অব পেমেন্টের (বিওপি) ওপর চাপ বাড়ছে। সরকারি সংস্থার সঞ্চয়ের অর্থ জমা রাখার জন্য বেসরকারি ব্যাংকের সুযোগ বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু জনগণের টাকা মন্দ ব্যাংকগুলোয় বিনিয়োগ করে অপব্যবহার রোধের ক্ষেত্রে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে না।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন বক্তারা। ‘পলিসি ইনসাইটস’ নামের একটি অর্থনীতিবিষয়ক নতুন ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন প্রকাশ উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পিআরআই’র সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত এ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য অধ্যাপক ড. শামসুল আলম।
এ সময় জিডিপির প্রাক্কলন নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার তথ্যের বিষয়ে বক্তারা বলেন, মানসম্পন্ন তথ্য দিতে হলে পরিসংখ্যান ব্যুরোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি হলেই তাকে সাফল্য হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করে সরকার। এ রাজনীতিকরণ বন্ধ করাও গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করি। তাই অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ যুক্ত করব। তবে গবেষকদের কাজ হচ্ছে তারা যেন আমাদের সমস্যাগুলো নিয়ে নির্দেশনা দিতে থাকেন। তাদের গবেষণা থেকে আমরা শিখতে থাকব। তবে তারা আমাদের অর্জনগুলোকে অস্বীকার করতে পারবেন না।’
এ সময় পিআরআই’র চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তার বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ও উন্নয়নঘনিষ্ঠ বিষয়ে মৌলিক গবেষণাকর্মকে নীতিনির্ধারকদের সামনে আনতে পলিসি ইনসাইটস নামের ম্যাগাজিনটির প্রকাশ শুরু করা হচ্ছে। এটি পিআরআই’র মুখপত্র হিসেবেও কাজ করবে। এতে গবেষকদের মানসম্মত ও গ্রহণযোগ্য তথ্য সংবলিত নিবন্ধ প্রকাশ করা হবে। উদ্বোধনী সংখ্যায় যন্ত্রায়ন, কর্মসংস্থান ও শিল্পায়ন বিষয়ে একটি গবেষণাকে মুখ্য হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়া সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা, বিটকয়েন, অ্যাপসভিত্তিক রাইট শেয়ারের অর্থনৈতিক অবদান, দারিদ্র্য বিমোচন পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কয়েকটি নিবন্ধন প্রকাশিত হয়েছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জিইডি’র সদস্য অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, ‘নিরপেক্ষ ও নির্মোহভাবে নীতিগত বিষয়ে গবেষণা প্রকাশ করলে নতুন ম্যাগাজিনটি গ্রহণযোগ্যতা পাবে। এর আগে ঢাকা কুরিয়ার, ফোরামসহ আরও বিভিন্ন বিশ্লেষণধর্মী ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তারা ধারাবাহিকভাবে থাকেনি। অথচ ভারতে ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি (ইপিডব্লিউ) নামের ম্যাগাজিনটি দীর্ঘদিন জনপ্রিয়তা ও মান ধরে রাখতে পেরেছে। নতুন প্রকাশনার কাছে এমনটাই প্রত্যাশা। তারা মান ধরে রাখতে পারলে দেশও উপকৃত হবে।’
দেশে মানসম্মত গবেষণা ও তথ্যের অভাব পূরণের পাশাপাশি এ ম্যাগাজিনের মাধ্যমে নীতিনির্ধারকদের জন্য দিকনির্দেশনা থাকবে বলে আয়োজকরা জানান। পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন শিল্পোদ্যোক্তা সৈয়দ মনজুর এলাহী, অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফা কে মুজেরি, পিআরআই পরিচালক ও প্রকাশিত সাময়িকীর প্রধান সম্পাদক মোহাম্মদ এ. রাজ্জাক প্রমুখ।
এ সময় বক্তারা সাময়িকীর প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা করেন। সামষ্টিক অর্থনীতির অসামঞ্জস্যের বিষয়ে ড. আহসান মনসুর তার প্রবন্ধে বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে ২০১১ সালে অর্থনীতিতে বড় অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছিল, এবার আবার ২০১৮ সালে দেখা যাচ্ছে ব্যাপক ভারসাম্যহীনতা। বাজারকে বাজারের মতো করে প্রবাহিত হতে দেওয়া হচ্ছে না। সে সঙ্গে ব্যাংক খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না, যা আগে কখনোই হয়নি। মন্দ ব্যাংকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঞ্চয় রাখার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এর অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে না।
ব্যাংক ও বিভিন্ন শিল্প খাতের উদ্যোক্তা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, যেসব ব্যাংকের এনপিএল ১০ শতাংশের বেশি, সেসব ব্যাংকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের টাকা রাখা উচিত নয়। কিন্তু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে তারা হয়তো সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের এসব বিষয়ে সংশোধন করা দরকার। এছাড়া ব্যবসার ব্যয় হ্রাসের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-প্রযুক্তিনির্ভর হচ্ছে। এইচএনএমের মতো ক্রেতাগোষ্ঠীর চার দশমিক আট বিলিয়নের মতো পোশাক অবিক্রীত রয়েছে; কারণ তারা ডিজিটাল মার্কেটিং ব্যবস্থায় যেতে পারেনি। ফলে তারা ব্যবসা হারাচ্ছে। অন্যদিকে ইতালির জারা ব্র্যান্ড বিস্তার লাভ করছে। এভাবেই অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশকে মানিয়ে নিতে হবে। এজন্য আমাদের এমবিএ পাস করার চেয়ে ভোকেশনাল পাস করা কর্মী বেশি দরকার। কিন্তু তার বিপরীতটাই হচ্ছে।