Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 8:21 pm

গৃহঋণে বেশিরভাগ ব্যাংকের সুদহার এখনও ১০ শতাংশের বেশি

তানিয়া আফরোজ এ্যানি: কয়েক বছর ধরে শিল্প খাতে ঋণপ্রবাহে আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি নেই। এজন্য বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ভোক্তাঋণকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম আবাসন খাত। এ খাতে ঋণ দেওয়ায় ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাবও দেখা যাচ্ছে। ফলে গত বছরের মাঝামাঝি থেকে অনেক ব্যাংক সুদহার কমিয়ে এক অঙ্কে (১০-এর নিচে) নামিয়ে আনে। তবে প্রথম সারির কয়েকটি ব্যাংকে গৃহঋণের সুদহার এখনও অনেক বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গৃহঋণের সর্র্বোচ্চ সুদহার মার্কেন্টাইল ব্যাংকের। এ খাতে ব্যাংকটি সাড়ে ১৩ থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে। এরপর রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। গৃহঋণে ব্যাংকটি সাড়ে ১২ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে।

গৃহঋণে সর্বোচ্চ সুদহার অরোপ করা মার্কেন্টাইল ব্যাংকের রিটেইল বিভাগের প্রধান ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আদিল রাইহান শেয়ার বিজকে বলেন, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের গ্রাহক দল (টার্গেট গ্রুপ অব কাস্টমার) সাধারণত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত ও গ্রাম। এ শ্রেণির গ্রাহকদের ঋণ দিতে গেলে বেশি ঝুঁকি নিতে হয়। ফলে রিস্ক প্রিমিয়াম বেশি। এ কারণে আমাদের সুদহারও তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে মার্কেন্টাইল ব্যাংক সব দিক থেকে ভালো করছে। এভাবে এগিয়ে গেলে আশা করি আগামী বছরে গৃহঋণের সুদহার ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হবো।

ইসলামী ব্যাংকের রিটেইল, কনজ্যুমার ও রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট বিভাগের প্রধান আবু নাসের মোহাম্মদ নাজমুল বারি বলেন, গৃহঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার জন্য স্টাডি শুরু করা হয়েছে। শিগগিরই এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবনা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে পেশ করা হবে।

উল্লেখ্য, বর্তমানে মুনাফার দিক দিয়ে শীর্ষ ৯ ব্যাংকের মধ্যে অবস্থান করছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও গৃহঋণ প্রসার ঘটাতে শুরু করেছে ব্যাংকটি। বর্তমানে ১২০ কোটি টাকার গৃহঋণ পোর্টফোলিও রয়েছে ব্যাংকটিতে। আর ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড সারা দেশে বিস্তৃত ৩২৫টি শাখার মাধ্যমে গৃহঋণ বিতরণ করে থাকে। ব্যাংকটির মোট সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার গৃহঋণ পোর্টফোলিও রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত গ্রাহকের ধরন ও প্রকৃতিভেদে গৃহঋণের সুদ হার ওঠানামা করে। ঋণের গুণগত মানের ওপর ভিত্তি করে সুদহারে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়। তবে স্বাভাবিক ক্ষেত্রে গৃহঋণে সুদহার খুব বেশি পরিবর্তন হয় না। সাধারণত কোনো ব্যাংকের তহবিল ব্যয় (কস্ট অব ফান্ড) বেশি হলে ব্যাংকের সুদহার বেশি হয়। আবার সুদহার নির্ধারণে গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংকের সম্পর্কের বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয় বলে জানায় অনেক ব্যাংক সূত্র।

এদিকে গৃহঋণে দুই অঙ্কের সুদহার বহাল আছে ঢাকা ব্যাংকে। এ ব্যাংকে গৃহঋণের সুদহার সাড়ে ১০ থেকে সাড়ে ১৩ শতাংশ। প্রিমিয়ার ব্যাংকে ১০ থেকে ১৩ শতাংশ, এবি ব্যাংকে সাড়ে ১০ শতাংশ থেকে সাড়ে ১৩ শতাংশ, যমুনা ব্যাংকে ১১ থেকে ১৪ শতাংশ, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকে সাড়ে ১০ শতাংশ থেকে সাড়ে ১৩ শতাংশ, এনবিএলে ১০ থেকে ১৩ শতাংশ ও এনসিসি ব্যাংক সাড়ে ১০ থেকে সাড়ে ১১ শতাংশ সুদ বর্তমান আছে।

বর্তমানে দুই অঙ্কের সুদ নেওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঢাকা ব্যাংক। ব্যাংকটির রিটেইল ব্যাংকিংয়ের প্রধান ও সিনিয়র অ্যাসিসট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. শাফকাত হোসেন শেয়ার বিজকে জানান, শিল্পায়নে ঋণ সরবরাহের জন্য বেশি পরিমাণে আমানত সংগ্রহের প্রয়োজনে আমানতের সুদহার অনেক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে আমাদের কস্ট অব ফান্ড বেড়ে গিয়েছিল। তাই এখন চট করে গৃহঋণের সুদহার কমানো যাচ্ছে না। যদিও ২০১৫ সালের প্রথম থেকে আমরা রিটেইল ব্যাংকিংয়ে ফোকাস করার পর এ খাতের সুদহার ১৪, ১৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। আশা করছি, অক্টোবর মাসের মধ্যে এ হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে সক্ষম হবো। অনেক ব্যাংক আছে গৃহঋণের সুদহার ৯.৯৯ শতাংশ রেখে এক অঙ্ক দাবি করে। সেভাবে নয়, আমরা প্রকৃতপক্ষেই এক অঙ্কে নামাবো বলে আশা করি।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের গৃহঋণ পোর্টফোলিও ১২৩ কোটি টাকা। তবে সুদহার এখনও দশ শতাংশের ওপরে। এ বিষয়ে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার ফজলে রশিদ জানান, কৌশলগত কারণে এখন আমরা গৃহঋণের সুদহার বাড়িয়ে রেখেছি। হয়তো এ হার কমাবো। অন্যান্য ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধি যেখানে ১০ থেকে ১২ শতাংশ, আমাদের ব্যাংকে ৩০ শতাংশ। বেশি ঋণ দেওয়ার প্রয়োজনে আমাদের বেশি সুদহারে আমানত সংগ্রহ করতে হয়। ফলে আমাদের কস্ট অব ফান্ড বেশি।

প্রসঙ্গত, গৃহঋণের সুদহার বাজারনির্ভর। এ সুদহার নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ধরাবঁাঁধা নিয়ম নেই। ২৫ বছর মেয়াদি ঋণে সুদহারের ওঠানামার ওপর গ্রাহকের সুদহার পরিবর্তিত হতে পারে। তবে কোনো কোনো ব্যাংক সুদহার দীর্ঘ মেয়াদের জন্য নির্ধারণ করে দেয়। গৃহঋণ বন্ধকনির্ভর হওয়ায় ঝুঁকির পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম থাকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে দেশে গৃহঋণের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি লক্ষ করা যায়। দেশের মোট গৃহঋণের ৫৫ শতাংশ বিতরণ করে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। ২০১৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত বেসরকারি ব্যাংকগুলো মোট প্রায় ৩০ হাজার ৯০০ কোটি টাকার গৃহঋণ বিতরণ করে। ২০০৬ থেকে বিতরণের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ বছরে বেসরকারি বাণিজ্যিক খাতের গৃহঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৯ গুণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা শেয়ার বিজকে বলেন, গৃহঋণের সুদহার বাজারনির্ভর। বেশিরভাগ ব্যাংক সুদহার কমিয়ে এনেছে। এটাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। যারা কমাতে পারেনি, আশা করবো তারাও কমিয়ে আনবে।

এদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বর্তমানে গৃহঋণে সর্বনিম্ন সুদহার ধার্য করেছে ব্র্যাক। ব্যাংকটির সর্বনিম্ন সুদহার ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। এরপর ইস্টার্ন ব্যাংকের (ইবিএল) সুদহার সাড়ে ৮ শতাংশ, আইএফআইসির ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, দ্য সিটি ব্যাংকের সুদহার সাড়ে ৯ শতাংশ।