Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 3:09 pm

গোলাপ চাষে স্বনির্ভর এক জনপদ

ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত জীবন সবারই কাম্য। রাষ্ট্রনায়ক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে বের করতে চান। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ নিজ উদ্যোগে নানাভাবে স্বনির্ভর হয়ে ওঠার নজির স্থাপন করছে। পাঠকদের জন্য আজ শুধু তেমন একজন ব্যক্তি নন, বরং কয়েকটি গ্রামের  হাজারো মানুষের আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার গল্প শোনাব। স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য তারা সৌন্দর্য ও ভালোবাসার প্রতীক ফুলকে সহায় করেছেন।

ঢাকার সাভার উপজেলার বনগাঁও, বিরুলিয়া ও সাভার ইউনিয়নের গ্রামগুলোয় গোলাপ চাষ হয় দীর্ঘদিন ধরে। এসব স্থানের রাস্তার দুই পাশে রয়েছে ফসলি জমি। আশপাশে যত দূরে চোখ বুলানো যায় শুধুই গোলাপের সমারোহ। বিস্তীর্ণ জমিগুলোয় বছরের পর বছর গোলাপের চাষ হয়ে আসছে। দিনে দিনে এসব গ্রামের মানুষের জীবনধারণের প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে গোলাপ চাষ। সম্প্রতি সাভারের গোলাপ গ্রাম নামে পরিচিত স্থানগুলোয় ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।

ফুলচাষের এ বিপ্লবের শুরু দুই যুগেরও বেশি আগে। আশির দশকের শুরুর দিকে এসব অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত সংকটাপন্ন। তখন মানুষেরা বসতবাড়িসংলগ্ন জমিতে নানা শাকসবজি চাষাবাদ করতেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এ চাষাবাদে বেশিরভাগ সময় লোকসানের মুখোমুখি হতেন তারা। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য গোলাপের চাষ শুরু করেন স্থানীয় এক উদ্যোক্তা। একজন ফুলচাষির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল গোলাপ চাষের শুরুর সে গল্প। তিনি জানান, প্রায় দুই যুগ আগে এখানকার এক ব্যক্তি রাজধানীর মিরপুর চিড়িয়াখানায় চাকরি করতেন। শিক্ষিত মানুষ ছিলেন তিনি। একই সঙ্গে চিড়িয়াখানার বাগানে চাকরির সুবাদে বুঝতে পারেন এ ফুল চাষ করে বেশ লাভবান হওয়া সম্ভব। এরপর দুই থেকে তিন বিঘা জমিতে চাষাবাদ করেন তিনি। এতে সফল হন। তার সফলতায় অনুপ্রাণিত হয়ে আশপাশের তিনটি ইউনিয়নের মানুষ গোলাপ চাষে সম্পৃক্ত হতে শুরু করে। সফল এ উদ্যোক্তাকে অনুসরণ করে স্থানীয় অনেক চাষি সফলতার মুখ দেখেন। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি এমন হয়ে ওঠে যে, স্থানীয় প্রায় সবার আর্থিক স্বনির্ভরতার প্রধান উৎস হয়ে ওঠে গোলাপ চাষ।

গোলাপের গ্রামগুলো ঘুরে কথা হয় অনেক কৃষক ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তারা জানান, গোলাপ এখন আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষের আয়ের প্রধান উৎস। অনেকে অতীতে শাকসবজি বা অন্য ফসল চাষাবাদ করতেন, তারা এখন গোলাপ চাষের দিকে ঝুঁকছেন। কারণ গোলাপ এরই মধ্যে অর্থকরী ফসল হিসেবে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে।

জানা যায়, প্রতিবিঘা জমি থেকে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার গোলাপের স্টিক সংগ্রহ করা যায়। সাধারণত অর্ধফুটন্ত অবস্থায় গোলাপের স্টিক কাটা হয়। মৌসুম ছাড়া অন্য সময়ে দুই থেকে পাঁচ টাকায় বিক্রি করা হয় একেকটি স্টিক। সে হিসেবে দিনে কোনো চাষি গড়ে ছয় হাজার টাকা উপার্জন করতে পারেন। তাছাড়া ভরা মৌসুমে, অর্থাৎ বিভিন্ন দিবস, যেমন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসা দিবস, পূজাপার্বণ, ঈদ প্রভৃতিতে গোলাপের কদর বাড়ে। তখন প্রতিটি গোলাপের স্টিক বিক্রি হয় সাত থেকে ১০ টাকায়।

গোলাপের এ বিশাল অঞ্চলের অন্যতম একটি গ্রাম সাদুল্লাপুর। গ্রামটি ঘুরে দেখা যায়, চাষিরা গোলাপ ক্ষেতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ ক্ষেতের পরিচর্যা করছেন, কেউ ফুলের স্টিক সংগ্রত করছেন, কেউবা আবার ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের কাছে সেগুলো বিক্রি করছেন। গোলাপের এ সুবিস্তীর্ণ সমারোহ উপভোগ করার সময় কথা হয় মালেক মিয়া নামের একজন চাষির সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি শাকসবজি ও ফলমূলের আবাদ করতাম, কিন্তু সফল হতে পারিনি। সেদিন গত হয়েছে। এখন গোলাপ চাষ করে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালোই আছি।

স্থানীয় আরও অনেকে জানান, বিরুলিয়া, বনগাঁও ও সাভার ইউনিয়নের সিংহভাগ মানুষের জীবন ফুলের ওপর নির্ভরশীল। এখানকার ফুল নানা উৎসব ও দিবসের চাহিদা পূরণ করে চলেছে। দেশের নানা অঞ্চল যেমন ফেনী, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, কক্সবাজার, রাজশাহী প্রভৃতি জেলার ফুলের জোগানদাতা এ গ্রামগুলো। বাংলাদেশে ফুলের রাজধানী-খ্যাত যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীর মতো এখানকার কৃষকের জীবনও পাল্টে গেছে গোলাপ ফুল আবাদ করে। বাণিজ্যিক কৃষির হিসেবে এক বিঘা জমিতে ফুলচাষ করে যে লাভ হয় তা যে কোনো ফসলের চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি।

যে গ্রামগুলো কেউ চিনত না, সেগুলো এখন গোলাপের জন্য সারা দেশে পরিচিত হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে শত শত মানুষ এখানে বেড়াতে আসছেন। গ্রামের পর গ্রামের জমিতে গোলাপের মাঝে হাঁটার সময় মনে হবে কোনো স্বপ্নপুরীতে আছেন। ভ্রমণপিপাসুরা একদিকে যেমন গোলাপের সুবাসে নিজের মনকে ভরিয়ে তুলছেন, একই সঙ্গে হাজারো মানুষের জীবন পরিবর্তনের গল্প শুনে আশ্চর্যান্বিত হচ্ছেন।

স্থানীয়দের সূত্রে জানা গেল, এসব গ্রামের বেশিরভাগ মানুষেরই দুই থেকে তিন বিঘা জমি রয়েছে। তারা সেখানে গোলাপের চাষ করেন। এ ফুল চাষ করে কৃষকেরা যেমন স্বাবলম্বী হচ্ছেন, তেমনি ক্ষেতে কাজ করে বেকারদের কর্মসংস্থান হচ্ছে। কিন্তু ফুল চাষ যখন কৃষি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পৌঁছে গেছে, তখন উদ্যোক্তা চাষিরা পড়েছেন নতুন সংকটে। প্রাকৃতিক ফুলকে এখন প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে বিদেশি কৃত্রিম ফুলের সঙ্গে। বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা ফুলের কারণে চাষিদের অনেক সময় কম দামে গোলাপ বিক্রি করতে হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কৃত্রিম ফুল আমদানি বন্ধে সংশ্লিষ্টদের সহায়তা চান এখানকার উদ্যোক্তারা।

  অনিক আহমেদ