গোল্ডেন সনের বন্ড লাইসেন্স বাতিল

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের দায়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ‘গোল্ডেন সন লিমিটেড’-এর বন্ড লাইসেন্স বাতিল করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। একই সঙ্গে ৩০ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়েছে কোম্পানিটিকে। গত রোববার (২৯ অক্টোবর) এ-সংক্রান্ত চিঠি ইস্যু করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস।

উল্লেখ্য, অবৈধভাবে অপসারিত কাঁচামালের শুল্ককর ফাঁকি এবং অবৈধভাবে অপসারণের উদ্দেশ্যে মজুদ করা কাঁচামালের শুল্ক কর বাবদ মোট ১৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগে ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট দায়ের করা মামলায় রায় প্রদান করে চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট।

বর্তমানে দেশের বাইরে থাকায় গোল্ডেন সন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বেলাল আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে বিদেশ যাওয়ার আগে শেয়ার বিজকে তিনি বলেন, ‘বন্ড কমিশনার তো এসআরও না মেনে শতভাগ রফতানি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছেন। তিনি চলতি বছরের ২৫ মে থেকে এখন পর্যন্ত আমার বন্ড নিবন্ধন নবায়ন করেননি। ফলে এ সময়ে আমি কাঁচামাল আমদানি করতে পারিনি। গত বছরেও এ কারণে আমি আট মাস কাঁচামাল আমদানি করতে পারিনি। এমন হলে তো আমাকে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। আর বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশও দিতে পারব না।’

এ প্রসঙ্গে কাস্টমস ও বন্ড কমিশনারেট কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার আমির মামুন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের ক্ষেত্রে একাধিকভাবে অভিযুক্ত গোল্ডেন সন লিমিটেড। ফলে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে একাধিক মামলা হয়েছে। এসব অনিয়মে প্রতিষ্ঠানটির বন্ড লাইসেন্স বাতিল করা হলো।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের এহেন কর্মকাণ্ড The Customs Act, ১৯৬৯-এর Section  ১৩(৩), ৩২, ৮৬, ৯৭ এবং Section ১৩(১)-এর সঙ্গে পঠিতব্য বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধিসমূহ এবং লাইসেন্সি কর্তৃক পালনীয় শর্তাবলির শর্ত নং-২, ৩, ৫, ৬ ও ১১-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যা The Customs Act ১৯৬৯-এর Section ১৫৬(১)-এর টেবিলের দফা ১, ৫৯, ৬০, ৬১, ৬২ ও ৯০ মোতাবেক শাস্তিযোগ্য এবং একটি অপরাধপ্রবণ প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এবং সব শর্ত পূরণ হওয়ায় একই আইনের Section-১৩(৩)-তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বন্ড লাইসেন্স বাতিলযোগ্য।’

চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট সূত্রে জানা যায়, বন্ড সুবিধায় হোম কনজাম্পশন ও রফতানিমুখী পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করে থাকে পুঁজিবাজারের ২০০৭ সালে তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের কোম্পানি গোল্ডেন সন লিমিটেড। এসব কাঁচামালে এ কারখানায় উৎপাদিত হয় পোশাক শিল্পের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন এক্সেসরিজ, গৃহস্থালি ব্যবহৃত পট, ফুড ওয়ামার, স্ট্যান্ডফ্যান, টেবিলফ্যান প্রভৃতি। কিন্তু আমদানি করা কাঁচামাল বন্ড গুদাম থেকে অবৈধভাবে অপসারণ, যথাযথভাবে উৎপাদনের কাজে ব্যবহার না করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি, বিক্রির উদ্দেশ্যে পরিবহন, বন্ড রেজিস্টারের স্থিতির অপেক্ষায় বন্ড গুদামে বেশি কাঁচামাল পাওয়া ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে শুরু থেকে এ পর্যন্ত আরও কিছু অভিযোগে গত পাঁচ বছরের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এবং কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট মিলে মোট ২৬টি মামলা করে। এসব মামলার অভিযোগে রয়েছে মোট ২১ কোটি ৬৯ লাখ ছয় হাজার ৩৫৯ টাকার শুল্ক ফাঁকি, যা শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এবং বন্ড কমিশনারেট অফিসের একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে। আর এরই মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর গত ২১ মার্চ ২০১৩ থেকে এ পর্যন্ত মোট ১৭টি মামলা করে। এ ১৭টি মামলায় জড়িত পণ্যের মূল্য ১০ কোটি ৩৩ লাখ ৯১ হাজার ৪৭৯ টাকা এবং জড়িত রাজস্ব তিন কোটি ৯৫ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। অন্যদিকে চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ২০১৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত মোট ৯টি মামলা করে। এ ৯টি মামলায় জড়িত পণ্যের মূল্য ৪১ কোটি তিন লাখ ৩৮ হাজার ২৬১ টাকা এবং জড়িত রাজস্ব ১৭ কোটি ৭৩ লাখ ১২ হাজার ৩৫৯ টাকা। এর মধ্যে একটি হলো ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট অবৈধ অপসারিত কাঁচামালের শুল্ক কর ফাঁকি এবং অবৈধ পণ্য অপসারণের উদ্দেশ্যে মজুদকৃত কাঁচামালের শুল্ক কর বাবদ মোট ১৩ কোটি ২৯ লাখ এক হাজার ৮১১ দশমিক ৬১ টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগে মামলায় রায় প্রদান করে চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। গত ২৯ অক্টোবর এই আদেশের চিঠি ইস্যু করে এ দফতর।

এ আদেশে বলা হয়, The Customs Act, ১৯৬৯-এর Section  ১৩(৩), ৩২, ৮৬, ৯৭ এবং Section ১৩(১)-এর সঙ্গে পঠিতব্য বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধিসমূহ এবং লাইসেন্সি কর্তৃক পালনীয় শর্তাবলির শর্ত নং-২, ৩, ৫, ৬ ও ১১-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যা The Customs Act ,১৯৬৯-এর Section ১৫৬(১)-এর টেবিলের দফা ১, ৫৯, ৬০, ৬১, ৬২ ও ৯০ মোতাবেক শাস্তিযোগ্য এবং একটি অপরাধপ্রবণ প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এবং সকল শর্ত পূরণ হওয়ায় একই আইনের Section-১৩(৩)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বন্ড লাইসেন্স বাতিলযোগ্য।

আদেশে আরও বলা হয়, The Customs Act, ১৯৬৯-এর Section১৩(৩), ৩২, ৮৬, ৯৭ এবং Section ১৩(১)-এর সঙ্গে পঠিতব্য বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধিসমূহ এবং লাইসেন্সি কর্তৃক পালনীয় শর্তাবলির শর্ত নং-২, ৩, ৫, ৬ ও ১১ লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায়  The Customs Act, 1969-Gi Section 156-Gi Table-Gi Clause ১, ৫৯, ৬০, ৬১, ৬২  ৯০ মোতাবেক মেসার্স গোল্ডেন সন লিমিটেডকে ৩০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড আরোপ করা হয়। আর আরোপিত অর্থদণ্ড বাবদ ৩০ কোটি টাকা, অবৈধ অপসারিত কাঁচামালের প্রযোজ্য শুল্ককর ১০ কোটি ৪৪ লাখ ১৫ হাজার ৯১৩ দশমিক ৮১ টাকা এবং অবৈধ অপসারণের উদ্দেশ্যে মজুদকৃত কাঁচামালের শুল্ক কর দুই কোটি ৮৪ লাখ ৮৫ হাজার ৮৯৭ দশমিক ৮০ টাকাসহ সর্বমোট ৪৩ কোটি ২৯ লাখ এক হাজার ৮১১ দশমিক ৬১ টাকা এই আদেশ জারির ১৫ (পনের) দিনের মধ্যে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমাদানপূর্বক ট্রেজারি চালানের মূল কপি এ দফতরে দাখিল করার জন্য আদেশ দেওয়া হলো।

আদেশে আরও বলা হয়, অব্যাহত অভিযোগের উপরোক্ত তথ্য-উপাত্তের পর্যালোচনায় বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব ফাঁকির কর্মকাণ্ডে ইচ্ছাকৃত এবং অপরিবর্তনীয় ঙভভবহফবৎ-ও বটে। ধারাবাহিক অপরাধপ্রবণ কার্যক্রম বন্ড ব্যবস্থাপনাকে বিঘিœত করে রাজস্বের ক্ষতিসাধন করছে, যা অনভিপ্রেত ও যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সার্বিক পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বন্ডার কর্তৃক কাঁচামাল মজুদ পরীক্ষাকালীন প্রতিবেদন স্বাক্ষর করে প্রতিবেদনোক্ত তথ্য/উপাত্তসমূহ স্বীকার করে নেওয়ায় এবং শুল্ককরমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামালের অপসারণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায়, সেমি ফিনিশড এবং ফিনিশড গুডসের বিষয়ে আনীত অভিযোগ খণ্ডাতে ব্যর্থ হওয়ায় কারণ দর্শানো নোটিসের বর্ণিত অভিযোগসমূহ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত।

(৩১ অক্টোবর, ২০১৭। প্রিন্ট ভার্সনে প্রকাশিত। আজ ডিএসইতে দেয়া ঘোষণার প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করা হচ্ছে)

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০