নিজস্ব প্রতিবেদক: বর্তমানে মুনাফায় রয়েছে দেশের গ্যাস বিতরণকারী প্রতিটি কোম্পানি। তবে উচ্চদরে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির জন্য লোকসান গুনছে পেট্রোবাংলা। এ জন্য গ্যাসের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে খাতভেদে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ বা তারও বেশি হারে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। দাম বাড়ানোর প্রস্তাবও আমলে নিয়েছে বাংলাদেশে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে গণশুনানি।
২১ থেকে ২৪ মার্চ এ শুনানি অনুষ্ঠিত হবে রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে। প্রথমদিন (২১ মার্চ) পেট্রোবাংলা ও গ্যাস সঞ্চালন কোম্পানি জিটিসিএলের প্রস্তাবের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। ২২ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে সুন্দরবন ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির প্রস্তাবের ওপর শুনানি, ২৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে তিতাস ও বাখরাবাদ গ্যাস বিতরণ কোম্পানির প্রস্তাবের ওপর শুনানি এবং ২৪ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে জালালাবাদ ও কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানির প্রস্তাবের ওপর শুনানি।
পেট্রোবাংলার প্রস্তাবে বলা হয়, ২০১৯-২০ অর্থবছর আট হাজার ৭৮২ দশমিক ৪৬ এমএমসিএম এলএনজি আমদানির বিপরীতে ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রকৃতপক্ষে ব্যয় করতে হয় ৪৪ হাজার ২৬৫ কোটি সাত লাখ টাকা। এর সঙ্গে দেশীয় ও বিদেশি কোম্পানি (আইওসি) থেকেও গ্যাস কেনা হয়েছে।
সব মিলিয়ে গ্যাস সরবরাহে চলতি অর্থবছর ব্যয় হবে ৬৫ হাজার ২২৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের সরবরাহ মূল্য পড়বে ২০ টাকা ৩৬ পয়সা। যদিও বর্তমানে গ্যাসের গড় বিক্রি মূল্য ৯ টাকা ৩৭ পয়সা। এ ঘাটতি মেটাতে গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে গ্যাসের মূল্য ১১৭ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে।
এদিকে বিতরণ কোম্পানিগুলো মূল্য নির্ধারণের ব্যাখ্যায় দেখিয়েছে, এলএনজি আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরে দেশি-বিদেশি গ্যাস কেনা ও সরবরাহ, পরিচালন ব্যয়, ভ্যাট-ট্যাক্স এবং নানা চার্জ মিলিয়ে ৬৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এর মধ্যে বছরে ৮৭৮ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানিতে ৪৪ হাজার ২২৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। অর্থাৎ প্রতি
ঘনমিটার এলএনজিতে ব্যয় ৫০ টাকা ৩৮ পয়সা, যার মধ্যে ক্রয়মূল্য ৩৬ টাকা ৬৯ পয়সা, আমদানি পর্যায়ে মূসক ৫ টাকা ৫০ পয়সা, অগ্রিম আয়কর ৭৪ পয়সা, ফাইন্যান্সিং ব্যয় ১ টাকা ৪৪ পয়সা, ব্যাংক চার্জ ও কমিশন ৫৯ পয়সা, রিগ্যাসিফিকেশন ব্যয় ১ টাকা ৮৬ পয়সা, অপারেশনাল ব্যয় ৫ পয়সা এবং ভোক্তা পর্যায়ে উৎসে কর ৩ টাকা ৫২ পয়সা।
দেশে কার্যরত আইওসি থেকে গ্যাস কিনতে ব্যয় হবে প্রতি ঘনমিটারে ২ টাকা ৯১ পয়সা। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (বিজিএফসিএল), সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (এসজিএফএল) এবং বাপেক্সের পরিচলন ব্যয় ধরা হয়েছে প্রতি ঘনমিটারে যথাক্রমে ৮৭ দশমিক ৯৮ পয়সা, ৩৩ দশমিক ৮৩ পয়সা এবং চার টাকা ৫৫ পয়সা। এ ছাড়া প্রতি ঘনমিটারে পরিচালন মার্জিন সঞ্চালন কোম্পানির (জিটিসিএল) ৮৬ দশমিক ৪৮ পয়সা, বিতরণ কোম্পানির ২৭ দশমিক ৪৯ পয়সা ধরা হয়েছে। আর প্রতি ঘনমিটারে পেট্রোবাংলার পরিচলন ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় পয়সা, গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে ৪৬ দশমিক ১৪ পয়সা এবং জ্বালানি উন্নয়ন তহবিলে ৮৮ দশমিক ৭০ পয়সা চার্জ ধরা হয়েছে। আর ভ্যাট ধরা হয়েছে ১৫ শতাংশ।
প্রস্তাবনা অনুযায়ী, রান্নার জন্য দুই চুলার সংযোগে বিল ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ১০০ টাকা এবং এক চুলার ব্যয় ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়। এ ছাড়া মিটারযুক্ত আবাসিক গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটারের গ্যাস দাম বর্তমানে ১২ টাকা ৬০ পয়সা। তা বাড়িয়ে ২৭ টাকা ৩৮ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
এদিকে শিল্পে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৩ টাকা ২৫ পয়সা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৭ টাকা চার পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩৭ টাকা দুই পয়সা এবং ক্যাপটিভে (শিল্প-কারখানায় নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাস) ১৩ টাকা ৮৫ পয়সার স্থলে ৩০ টাকা ৯ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার চার টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৬৭ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। একইভাবে চা বাগানে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৩ টাকা ২৫ পয়সা, হোটেল-রেস্টুরেন্টে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৯ টাকা ৯৭ পয়সা এবং সিএনজির দাম ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৬ টাকা পাঁচ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো।
গণশুনানিতে বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবনার পাশাপাশি কমিশনের গঠিত কারিগরি কমিটির বিশ্লেষণ তুলে ধরা হবে। তারা কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে সুপারিশ প্রদান করবে। পাশাপাশি শুনানিতে অংশ নিয়ে যে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন তাদের প্রস্তাবনা তুলে ধরবে। শুনানি শেষ হওয়ার ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যেই সাধারণত মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা দিতে হয়।
প্রসঙ্গত, সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সে সময় বাসাবাড়িতে দুই চুলার খরচ ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৭৫ টাকা আর এক চুলার খরচ ৭৫০ টাকা থেকে ৯২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়।