ইসমাইল আলী: গত এপ্রিল ও জুনে দুই দফা বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। এছাড়া বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির গণশুনানি চলছে। এরই মধ্যে আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এবার গ্রাহকভেদে গড়ে ৭৭ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করতে যাচ্ছে গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিগুলো। শিগগিরই এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) পাঠানো হবে।
পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হচ্ছে। আগামী বছর জাতীয় গ্রিডে এ গ্যাস যুক্ত হবে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির মূল্য অনেক বেশি। এতে দেশের বাজারে গ্যাসের সরবরাহ ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। ফলে এলএনজি ও নিজস্ব গ্যাসের মিশ্রণের ভিত্তিতে গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণ ব্যয় নির্ধারণ করা হবে।
আগামী এপ্রিলে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি যুক্ত হওয়ার কথা জাতীয় গ্রিডে। আর আগে দাম বৃদ্ধির জন্য গণশুনানিসহ কমপক্ষে তিন মাস সময় লাগবে। এজন্য দ্রুতই দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠানো হবে বিইআরসিতে, যাতে মার্চের মধ্যে দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়।
জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) মো. তৌহিদ হাসনাত খান শেয়ার বিজকে বলেন, আগামী বছর এলএনজি যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে। যদিও এলএনজির আমদানি মূল্য এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এ বিষয়ে কাতারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে এটির মূল্য নিজস্ব গ্যাসের চেয়ে অনেক বেশি হবে। তাই দুই ধরনের গ্যাসের মূল্য সংমিশ্রণ করে গ্রাহক পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করা হবে। এজন্য গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রস্তুত করা হচ্ছে। বিইআরসির লাইসেন্সী হিসেবে বিতরণকারী কোম্পানিগুলো এ প্রস্তাব পাঠাবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে গ্যাসের ওপর ১২২ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। তবে এলএনজির ওপর এ হারে শুল্ক আরোপ করা হলে গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাবে। এতে শিল্পোৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এনবিআর ভ্যাট ছাড়া গ্যাসের সব ধরনের শুল্ক মওকুফে সম্মত হয়েছে। ফলে কিছুটা সহনীয় দামে গ্যাস গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহ করা যাবে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দৈনিক সরবরাহ করা হচ্ছে দুই হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট (সাড়ে ৭৬ মিলিয়ন ঘনমিটার) গ্যাস। এতে ঘনমিটারপ্রতি গ্যাসের গড় বিক্রি মূল্য পড়ছে ছয় টাকা ৬৪ পয়সা। আর আমদানি করা এলএনজি থেকে প্রাপ্ত গ্যাসের সরবরাহ মূল্য পড়বে ঘনমিটারপ্রতি ২৫ টাকা ৪৬ পয়সা। এতে নিজস্ব গ্যাস ও এলএনজির সংমিশ্রণে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহ মূল্য পড়বে প্রতি ঘনমিটার ১১ টাকা ৭৫ পয়সা। এ হিসাবে ঘনমিটারপ্রতি গ্যাসের দাম বাড়ছে গড়ে পাঁচ টাকা ১১ পয়সা বা ৭৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
সম্প্রতি রাজধানীর পেট্রোবাংলায় অনুষ্ঠিত এক সভায় এলএনজির দাম নিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী নেতা ও খাতসংশ্লিষ্টদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে এলএনজি ও গ্যাসের সম্ভাব্য দাম তুলে ধরা হয়।
বৈঠকে বলা হয়, প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ধরা হয়েছে সাত ডলার। এতে প্রতি ঘনমিটার এলএনজির দাম পড়বে ১৯ টাকা ৭৮ পয়সা। এর সঙ্গে ব্যাংক চার্জ ২৫ পয়সা, রিগ্যাসিফিকেশন ব্যয় পড়বে এক টাকা ৩৮ পয়সা এবং বন্দরের চার্জ ও অন্যান্য প্রশাসনিক ব্যয় ৭৩ পয়সা। এতে ঘনমিটারপ্রতি গ্যাসের বিক্রয়মূল্য পড়বে ২২ টাকা ১৪ পয়সা। আর ভ্যাট দিতে ১৫ শতাংশ বা তিন টাকা ৩২ পয়সা। এতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের গড় দাম পড়বে ২৫ টাকা ৪৬ পয়সা। এর সঙ্গে দেশীয় গ্যাসের দামের মিশ্রণ হবে, যার ভিত্তিতে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করা হবে।
বৈঠকে উপস্থিত পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, এলএনজির দাম নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বাড়লে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি তো তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি সম্ভব নয়। ফলে জটিলতা সৃষ্টি হবে। আবার ডলার এক্সচেঞ্জ রেট বৃদ্ধির ঝুঁকিও রয়েছে। এছাড়া নিজস্ব গ্যাস ক্রমেই কমছে। ফলে এলএনজি আমদানি বাড়াতে হবে। এতেও দাম নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হবে।
নতুন হিসাবে, বিদ্যুতে সরবরাহকৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম পড়বে চার টাকা ৯৯ পয়সা, বর্তমানে যা তিন টাকা ১৬ পয়সা। অর্থাৎ দাম বাড়বে প্রায় ৫৮ শতাংশ। সার উৎপাদনে সরবরাহকৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের সম্ভাব্য দাম হবে চার টাকা ৭৫ পয়সা, বর্তমানে যা দুই টাকা ৭১ পয়সা। এ খাতে বাড়বে ৭৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। ক্যাপটিভে সরবরাহকৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ১৪ টাকা ৯৮ পয়সা, বর্তমানে যা ৯ টাকা ৬২ পয়সা। এ খাতে দাম বাড়বে ৫৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। আর শিল্পে সরবরাহকৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ১৪ টাকা ৯০ পয়সা, বর্তমানে যা সাত টাকা ৭৬ পয়সা। অর্থাৎ শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়বে ৯২ শতাংশ।
এদিকে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সরবরাহকৃত দাম বাড়বে ১০৫ শতাংশের বেশি। নতুন হিসাবে এ খাতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ৩৫ টাকা, বর্তমানে যা ১৭ টাকা চার পয়সা। সিএনজি ফিড গ্যাসের ক্ষেত্রে সরবরাহকৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ৫৯ টাকা ৭০ পয়সা, বর্তমানে যা ৪০ টাকা। এতে দাম বাড়বে ৪৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। চা-বাগানে সরবরাহকৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ১২ টাকা ১০ পয়সা, বর্তমানে যা সাত টাকা ৪২ পয়সা। এ খাতে দাম বাড়বে ৬৩ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম প্রস্তাব করা হয়েছে আবাসিকে। খাতটিতে (মিটারযুক্ত) গ্রাহকদের জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ১১ টাকা ২০ পয়সা, বর্তমানে যা ৯ টাকা ১০ পয়সা। এ হিসাবে খাতটিতে ২৩ শতাংশ দাম বাড়তে পারে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, আগামী বছর থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহের মাধ্যমে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। চাহিদার ভিত্তিতে শিল্প-কারখানায় গ্যাসের সঙ্গে এলএনজি মিশ্রিত করে গ্যাস সরবরাহ করা হবে। এতে মূল্য কিছুটা বেশি হলেও ব্যবসায়ীদের জন্য তা লাভজনক হবে।
Add Comment