Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 2:35 am

গ্যাসের সঞ্চালন চার্জ ৩৩২% বৃদ্ধির প্রস্তাব জিটিসিএলের

ইসমাইল আলী: দেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলিত গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর কাছে পৌঁছে দেয় গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। এছাড়া আমদানিকৃত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রি-গ্যাসিফাইড করার পরও তা বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর কাছে পৌঁছে দেয় এ কোম্পানিটি। এজন্য ট্রান্সমিশন (সঞ্চালন) চার্জ পায় জিটিসিএল। তবে হঠাৎ করেই এ চার্জ ৩৩২ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে কোম্পানিটি।

জ্বালানি বিভাগে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস সঞ্চালনে জিটিসিএল চার্জ পায় ০.৪৭৭৮ টাকা। তবে এ চার্জকে ২.০৪৬৯ টাকায় উন্নীত করতে হবে। অর্থাৎ প্রতি ঘনমিটারে সঞ্চালন চার্জ বাড়াতে হবে ১.৫৮৬৮৯ টাকা বা ৩৩২ শতাংশ।

এ চার্জ না বাড়ালে কোম্পানিটির পক্ষে নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন, কম্প্রেসার স্টেশন পরিচালনা, গ্যাস ট্রান্সমিশন গ্রিড ও আনুষঙ্গিক স্থাপনা পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং ঋণের সুদ ও আসল (ডিএসএল) পরিশোধসহ দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভবপর হবে না বলেও জানানো হয়। যদিও এ চার্জ বৃদ্ধির ফলে গ্যাসের দাম আরেক দফা বাড়াতে হবে।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জিটিসিএলের আয়ের মূল উৎস গ্যাস সঞ্চালন ট্যারিফ বা চার্জ। বর্তমানে কোম্পানির মোট গ্যাস সঞ্চালন নেটওয়ার্কের দৈর্ঘ্য দুই হাজার ১৭ কিলোমিটার। আগামী দুই বছরে বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর ও বাখরাবাদ-মেঘনাঘাট-হরিপুর প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নের পর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য হবে দুই হাজার ২১৭ কিলোমিটার। জিটিসিএল এলএনজি ব্যতীত চলতি অর্থবছর গড়ে দৈনিক গ্যাস সঞ্চালন করছে এক হাজার ৭০৬ মিলিয়ন ঘনফুট।

কোম্পানিটি গত অর্থবছর আমদানিকৃত এলএনজি দৈনিক গড়ে ৬৫৯ মিলিয়ন ঘনফুট পরিবহন করে। চলতি অর্থবছর জানুয়ারি পর্যন্ত দৈনিক গড়ে ৪৬২ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করে। এলএনজি পরিবহন কমায় চলতি অর্থবছর জিটিসিএলের আয়ও কমে যাবে। গত অর্থবছর কোম্পানিটি আয় করে এক হাজার ১২৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। তবে চলতি অর্থবছর আয় কমে দাঁড়াতে পারে এক হাজার ১১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।

এদিকে গত অর্থবছর থেকেই জিটিসিএল বর্তমানে বড় ধরনের লোকসানে রয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছর কোম্পানির লোকসানের পরিমাণ ছিল ২১৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছর সম্ভাব্য লোকসান ধরা হয়েছে ৬৬৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ লোকসান বাড়বে ৪৪৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বা ২০৭ শতাংশ। এছাড়া গত অর্থবছর জিটিসিএলের ক্যাশফ্লোতে ঘাটতি ছিল ১৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা, চলতি অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়াতে পারে এক হাজার ৬৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।

প্রস্তাবে জিটিসিএল তাদের ব্যয়ের প্রাক্কলন তুলে ধরেছে। এতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছর কোম্পানিটি ২০ হাজার ৯৯৩ এমএমসিএম গ্যাস সঞ্চালন করবে। এজন্য কোম্পানিটির রাজস্ব প্রয়োজন হবে ২৮ হাজার ৬৪৩ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন টাকা। অর্থাৎ প্রতি ঘনমিটার গ্যাস সঞ্চালনে ব্যয় হবে ১.৩৬৮৪ টাকা। এর থেকে জিটিসিএলের সুদ ও অন্যান্য আয় বাদ দিয়ে ঘনমিটারপ্রতি গ্যাস সঞ্চালন ব্যয় দাঁড়াবে ১.৩৪৮০ টাকা।

এদিকে ০.৪৭৭৮ টাকা ধরে চলতি অর্থবছর উৎসে আয়কর কর্তন বাদ দিয়ে জিটিসিএলের আয় দাঁড়াবে এক হাজার ১২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। কিন্তু ডিএসএল বাবদ এক হাজার ৩৬৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ও কোম্পানির নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পের ব্যয় বাবদ ২৬৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকাসহ মোট এক হাজার ৬৩০ কোটি ৯১ লাখ টাকা প্রয়োজন হবে। ফলে শুধু ডিএসএল পরিশোধেই জিটিসিএলের সঞ্চালন চার্জ থেকে প্রাপ্ত অর্থে ঘাটতি হবে ৬১৮ কোটি ছয় লাখ টাকা।

তারল্য সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ঋণের আসল, নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সরকারের লভ্যাংশ পরিশোধের জন্য প্রতি ঘনমিটারে ০.৪৬৭৫ টাকা হুইলিং চার্জ প্রয়োজন। এছাড়া যেসব পাইপলাইন ও অবকাঠামো নির্মাণে অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে, কিন্তু দেশীয় উৎপাদিত ও আমদানিকৃত গ্যাস স্বল্পতার কারণে পূর্ণ সক্ষমতার ব্যবহার হয় না, সেগুলোর বিনিয়োগ ব্যয়ের কস্ট রিকভারির জন্য পাইপলাইনের বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে ৪৮৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এতে প্রতি ঘনমিটারে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে ০.২৩১৪ টাকা।

সব মিলিয়ে প্রস্তাবিত সঞ্চালন চার্জ প্রাক্কলন করেছে জিটিসিএল। এতে দেখা যায়, সঞ্চালন ট্যারিফ দরকার প্রতি ঘনমিটারে ১.৩৪৮ টাকা, ডিএসএল প্রদানের জন্য প্রতি ঘনমিটারে ব্যয় হবে গড়ে ০.৪৬৭৫ টাকা এবং কস্ট রিকভারির জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দরকার প্রতি ঘনমিটারে ০.২৩১৪ টাকা। সব মিলিয়ে সঞ্চালন চার্জ প্রস্তাব করা হয়েছে ২.০৪৬৯ টাকা।

জানতে চাইলে জিটিসিএলের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বৈঠকে উপস্থিত জিটিসিএলের এক প্রতিনিধি বলেন, গ্যাস সঞ্চালন করে জিটিসিএল বড় ধরনের লোকসান করছে। এজন্য মন্ত্রণালয়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জমা দেয়া হয়েছে। তারা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাবেন। এখনই এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না।