Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 12:32 pm

গ্যাস অনুসন্ধান: জ্বালানি সংকট কাটিয়ে উঠতে সর্বোত্তম বিকল্প

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ক্রমবর্ধমান বাজারের অনিশ্চয়তায় বিশ্ব এনার্জি ল্যান্ডস্কেপ প্রভাবিত হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেও, সরবরাহের সীমাবদ্ধতা এবং একাধিক পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে জ্বালানির চাহিদা বেড়েছিল। ২০২০ সালে কভিড মহামারির শুরুতে গ্যাসের দাম ৩০ বছরের সর্বনি¤œ পর্যায়ে পৌঁছেছিল, ২০২১ সালে এটি প্রায় দুই দশকের উচ্চতায় পৌঁছেছে। বিদ্যুতের দামের ক্ষেত্রেও একই রকম অস্থিরতা দেখা যায়।

স্বল্প-কার্বন অর্থনীতিতে রূপান্তরের জন্য দীর্ঘমেয়াদি স্বল্প-কার্বন এনার্জি ব্যবস্থায় স্থানান্তরের কাজ গতি পেয়েছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ত্বরান্বিত হচ্ছে। কপ২৬-এর প্রেক্ষাপটে, উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি অনেক বড় করপোরেট হাউসগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় মোকাবিলায় আগামী কয়েক দশকের মধ্যে নিট জিরো নির্গমন অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অবশ্যই বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের একটি কারণ যা বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, যুদ্ধ না হলেও বাংলাদেশ জ্বালানি সংকটের মুখোমুখি হতো। ২০১৫ সাল থেকে স্থানীয় গ্যাস ক্ষেত্র থেকে উৎপাদন ও সরবরাহ হ্রাস পেয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতেও  হ্রাস অব্যাহত থাকবে। অন্যদিকে ভূ-বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুসারে,  বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যতটুকু গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে তার চেয়ে বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে।

ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) এবং পেট্রোবাংলার দুই বছরের যৌথ সমীক্ষায় (২০০১) দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৩২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) অনাবিষ্কৃত প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদের গড় সম্ভাবনা (৫০ শতাংশ)  রয়েছে। নরওয়ের পেট্রোলিয়াম অধিদপ্তর (এনপিপি) এবং হাইড্রোকার্বন ইউনিট (এইচসিইউ) যৌথ গবেষণায় (২০০১) প্রস্তাব করেছে, বাংলাদেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাস সম্পদের গড় সম্ভাবনা ৪২ টিসিএফ । ২০১১ সালে ইউরোপীয় তেল ও গ্যাস পরামর্শক   র‌্যামবল বাংলাদেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাস সম্পদ মূল্যায়ন হালনাগাদ করে এবং এটি ৩৪ টিসিএফ হওয়ার ব্যাপারে ৯০ শতাংশ সম্ভাবনার কথা জানান।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ বছরে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার করে। এর অর্থ হলো ৩২-৩৪ টিসিএফ অব্যবহƒত গ্যাস সম্পদ অনুসন্ধানের মাধ্যমে, আগামী ৩০ বছরের জন্য দেশে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা যেতে পারে। গ্যাস খাতে বাংলাদেশের আরও সম্ভাবনা থাকলেও বিশ্বের অন্যান্য গ্যাস বেসিনের তুলনায় অনুসন্ধান গ্যাস কূপের সংখ্যা কম।

বাংলাদেশের আয়তন ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গ কিমি এবং এখন পর্যন্ত মোট ১০০ অনুসন্ধানমূলক কূপ খনন করা হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আয়তন ১০ হাজার কিমি এবং সেখানে ১৫০টিরও বেশি কূপ খনন করা হয়েছে। এ ধরনের পরিসংখ্যানে প্রমাণ হয়, বাংলাদেশে অনুসন্ধানের হার কতটা কম। তবুও বাংলাদেশ ত্রিপুরার চেয়ে বেশি গ্যাসের মজুত আবিষ্কার করেছে।

২৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার মধ্যে, সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট অফ-গ্রিড (সোলার হোম এবং ক্যাপটিভ), যেখানে ৪ হাজার মেগাওয়াাট জোরপূর্বক বন্ধ রাখতে হচ্ছে অথবা জ্বালানি ঘাটতির কারণে চালু করা যাচ্ছে না। বর্তমান সংকট মেটাতে এবং ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজন মেটাতে বাংলাদেশ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু করেছে।

২০২৬ সালে, বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে এবং এর ফলে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অনেক সুযোগ-সুবিধা হারাবে। এছাড়া ক্রমহ্রাসমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সঙ্গে, পরবর্তী ২-৩ বছরের মধ্যে যখন বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের প্রক্রিয়া শুরু হবে তখন দেশটি কঠিন চাপের মধ্যে পড়বে বলে অনুমেয়। উপরন্তু, বেসরকারি খাতের ঋণের ২৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধের বিষয়টিও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের প্রক্রিয়া কঠিন করে তুলতে পারে।

তাই, এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরতা স্বল্পমেয়াদে কার্যকর হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে, মূল্যের অস্থিরতা এবং বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা আমদানিকে ভঙ্গুর করে তুলবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।

বাংলাদেশ সরকার ২০২৬ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। কিন্তু চলমান জ্বালানি সংকটে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হতে পারে। কারণ ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাটে বেশিরভাগ শিল্পে উৎপাদন তাদের উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে কম হয়।

সরকার সফলভাবে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি করে এর মালিকানা পেয়েছে ১০ বছর হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূ-বৈজ্ঞানিক কারণে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের বদ্বীপ এবং এর উপকূলীয় অঞ্চলকে প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এলাকা হিসেবে রেটিং করা হয়েছে। এই ধরনের রেটিংয়ের প্রমাণ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায়, উল্লেখযোগ্যভাবে মিয়ানমারের অফশোর রাখাইন অববাহিকা। যেখানে ২০১২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে সামুদ্রিক বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পর থেকে বড় আকারের গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। ব্যয়বহুল এলএনজি নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাস দ্বারা প্রতিস্থাপনের জন্য সমুদ্র এবং উপকূল উভয় ক্ষেত্রেই গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমকে বেগবান করতে হবে।

আইসিসিবি ত্রৈমাসিক বুলেটিনের সম্পাদকীয়