বিদ্যুৎ খাতের পরিকল্পিত উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে আগের মাস্টারপ্ল্যানের ব্যর্থতা ও ২৫ বছর মেয়াদি নতুন পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের দ্বিতীয় পর্ব
ইসমাইল আলী: ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে জোর দেয় সরকার। পরের বছর প্রণয়ন করা হয় বিদ্যুৎ খাতের মাস্টারপ্ল্যান। সেটাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস ও কয়লার ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। তবে তা অর্জন হয়নি। বরং তেলভিত্তিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে বেশি হারে। এজন্য গ্যাস ও কয়লার সরবরাহ ঘাটতিকে দায়ী করেছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)।
যদিও এর সঙ্গে একমত নন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সরকারের ভুল নীতির জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি তেলের ব্যবহার বেড়েছে। তিন বছরের জন্য রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্র অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। আর এ সময়ের মধ্যে গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বড় কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর কথা ছিল। তবে বড় কোনো কেন্দ্রই সময়মতো চালু হয়নি। উল্টো রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।
বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে নতুন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। জাইকার অর্থায়নে এটি প্রণয়ন করছে টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার সার্ভিস কোম্পানি। গত মাসে এ-সংক্রান্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে জাইকা। এতে আগের মাস্টারপ্ল্যানের ব্যর্থতার পাশাপাশি ২০৪১ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের গতিবিধি তুলে ধরা হয়েছে।
মাস্টারপ্ল্যানের তথ্যমতে, ২০১১-১২ অর্থবছর থেকেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যাত্রা শুরুর কথা ছিল। এজন্য প্রতি বছর গড়ে ১০ লাখ টন কয়লা ব্যবহারের কথা ছিল। এর বড় অংশের উৎস ছিল নিজস্ব কয়লা। কিন্তু বড় কোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যাত্রা শুরু করেনি এখনও। বড় পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে কিছু কয়লা ব্যবহার হয়। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তা অনেক কম।
একই অবস্থা গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এতে দেখা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের প্রয়োজন ছিল দুই হাজার ৬৭৩ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু সরবরাহ করা হয় দুই হাজার ৩৮ মিলিয়ন ঘনফুট। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা কিছুটা বাড়িয়ে দুই হাজার ২৪৭ মিলিয়ন ঘনফুট করা হয়। তবে সে সময় সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল দুই হাজার ৭৬৫ মিলিয়ন ঘনফুট। আর ছয় বছরে দৈনিক গড়ে দুই হাজার ৫০৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহের কথা ছিল। তবে বাস্তবে সরবরাহ করা হয় দুই হাজার ১৩২ মিলিয়ন ঘনফুট, যা লক্ষ্যমাত্রার ৮৬ শতাংশ।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ সংকট এখনও কাটেনি। গত মে মাসে গ্যাস সংকটে ১১টি কেন্দ্র বন্ধ ছিল। এতে বিদ্যুৎ ঘাটতি চরম আকার ধারণ করে। কয়েক দিন নিয়মিতই লোডশেডিং হয়।
কয়লা ও গ্যাসের ঘাটতির ফলে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমছে না। বর্তমানে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ২৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ বা তিন হাজার ৭০৪ মেগাওয়াট। যেখানে কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব মাত্র ২০০ মেগাওয়াট। আর গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে সাত হাজার ৮৪৪ মেগাওয়াট।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ শেয়ার বিজকে বলেন, কয়লাভিত্তিক কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পাইপলাইনে আছে। দ্রুতই এগুলো উৎপাদনে আসবে। ফলে কয়লার ব্যবহার আগামীতে বাড়বে। এছাড়া গ্যাসের সংকট মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আসছে আগামী বছর। এতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে। এতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্রমশ কমে আসবে।
মাস্টারপ্ল্যানে বলা হয়েছে, ২০১১ সালের হাইড্রো কার্বন ইউনিটের তথ্যের ভিত্তিতে আগের মাস্টারপ্ল্যানে গ্যাসের ব্যবহার ধরা হয়েছিল। তবে ছয় বছরে গড়ে ১৫ শতাংশ কম গ্যাস পাওয়া গেছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। এর মূল কারণ, ২০১০-১১ অর্থবছরের পর থেকে পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্যাস খাতের উন্নয়ন হয়নি বা যথাযথ বিনিয়োগ হয়নি। এতে নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি আবার পুরনো ক্ষেত্রগুলোও সংস্কার করা হয়নি। এছাড়া সে সময়ের গ্যাসের মজুদের তথ্যও ঠিক ছিল না।
এদিকে কয়লা উত্তোলন বৃদ্ধিতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এজন্য বিদ্যমান কয়লা খনিতে নতুন যন্ত্রপাতি বসানো দরকার হলেও তা করা হয়নি। এছাড়া পাঁচ বছরেও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়নি। যদিও এনার্জি মিশ্রণের জন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। কারণ এ সময় এক হাজার ৮৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কয়লা থেকে আসার কথা ছিল।
বিদ্যুৎ খাতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ বলেন, তিন বছরের জন্য লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল রেন্টাল-কুইক রেন্টালের। পরের সেগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে কয়েক দফা। এর মাধ্যমে দুর্নীতি আর উচ্চ মূল্যের বিদ্যুতের বোঝা জনগণের কাঁধে চাপানো হয়েছে। আর পরিকল্পিতভাবে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নির্মাণ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ দুষ্টচক্র থেকে এখনও দেশের বিদ্যুৎ খাত বের হতে পারেনি।