Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 5:34 am

গ্যাস সংকটে জ্বলছে না চুলা, ঘনঘন লোডশেডিং

নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতীয় গ্রিডে হঠাৎ করেই গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে। দৈনিক ৩৮০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে গ্যাস দেয়া হচ্ছে ২২০ থেকে ২২৫ কোটি ঘনফুট। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চরম গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। আবাসিকে গ্যাস থাকছে না সারাদিন। সিএনজি স্টেশনগুলোয়ও গ্যাসের চাপ না থাকায় গাড়ির লাইন থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গ্যাস সংকটে বিপাকে পড়েছে শিল্প ও বিদ্যুৎ খাত। বেড়ে গেছে দেশব্যাপী লোডশেডিং।

একটি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় প্রায় দেড় মাস ধরে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) সরবরাহ কম। এর মধ্যে মঙ্গলবার (৯ জুলাই) রাতে এক দুর্ঘটনায় পাইপলাইন ছিদ্র হয়ে যায়। এতে এলএনজি সরবরাহ আরও কমে গেছে। ফলে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ অনেক কমে গেছে। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন আবাসিকের গ্রাহকরা। দিনের খুব কম সময়ই লাইনে রান্নার জন্য গ্যাস পাওয়া যায়। এমন অনেক এলাকা আছে যেখানে সারাদিনও রান্নার মতো পর্যাপ্ত গ্যাস পাওয়া যায় না।

দুই সপ্তাহ ধরে রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় গ্যাস সংকটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, যেসব এলাকায় আগে পাওয়া যেত সেসব এলাকায়ও দুই সপ্তাহ ধরে গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় দিনের বেলায় গ্যাস মিললেও নিভু নিভু করে জ্বলে চুলা। আবার বিনা ঘোষণায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার ঘটনাও নিয়মিত হচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে হোটেল থেকে খাবার কিনে খেতে হচ্ছে, নতুবা বিকল্প হিসেবে এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে মাসের খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, গ্যাস সংকটে গতকাল (১১ জুলাই) ২৫টি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ ছিল। এ সময় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় তিন হাজার ৯৮৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্র বন্ধ ছিল। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ কমে যাওয়ায় ঢাকার বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। এমনকি স্বাভাবিক সময়ে রাজধানীতে লোডশেডিং না থাকলেও দুদিন ধরে তা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দুই থেকে তিন ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়। এর মধ্যে কক্সবাজারের মহেশখালীতে অবস্থিত দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি থেকে আসে ১১০ কোটি ঘনফুট। একটি টার্মিনাল মেরামতের জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানোর পর থেকে দৈনিক ৫৫ কোটি ঘনফুট পাওয়া যাচ্ছিল। তবে ৯ জুলাই রাত থেকে সরবরাহ হচ্ছে ২৫ কোটি ঘনফুট। এতে এখন গ্যাস সরবরাহ নেমে এসেছে ২২৫ কোটি ঘনফুটে।

ঘূর্ণিঝড় রেমালের কবলে পড়ে গত ২৭ মে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বন্ধ হয়ে যায় সামিটের টার্মিনালটি। এতে ৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ কমে যায়। মেরামত শেষে দেশে ফিরলে এটি থেকে এ মাসের মাঝামাঝি আবার গ্যাস সরবরাহ শুরু হতে পারে। তার আগে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এদিকে মঙ্গলবার (৯ জুলাই) রাতে আনোয়ারা-ফৌজদারহাট ৪২ ইঞ্চি পাইপলাইন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মহেশখালী ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে এলএনজি সরবরাহ কমে গেছে। সরবরাহ কমে যাওয়ায় দেশব্যাপী গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

গ্যাস সরবরাহ সংকটে সিএনজি স্টেশনগুলোয়ও ভোগান্তি চরমে উঠেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মহাখালীর ইউরেকা এন্টারপ্রাইজের সামনে গ্যাসের জন্য অপেক্ষমাণ যানবাহনের সারি মহাখালী রেলগেট অতিক্রম করে পৌঁছে গেছে এয়ারপোর্ট রোডে। এতে মহাখালী রেলগেট এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।

সিএনজি স্টেশনের সামনে গ্যাসের জন্য অপেক্ষমাণ এক সিএনজি অটোরিকশা চালক জানালেন, গত ঈদুল আজহার পর থেকেই এ অবস্থা। প্রতিদিনই গ্যাস নিতে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। আরেক অটোরিকশা চালক জানান, ৩০০ টাকার গ্যাস নিলে সারাদিন ট্রিপ মারতে পারেন। কিন্তু এখন ৩০০ টাকার গ্যাস একবারে পাওয়া দুরূহ হয়ে উঠেছে। তিন ঘণ্টার লাইনে দাঁড়িয়ে ১৫০ টাকার গ্যাস নিয়েছেন বলে জানিয়ে তিনি বলেন, তিন-চারটা ট্রিপ মারলেই গ্যাস শেষ হয়ে যাবে। সিএনজি স্টেশনটির এক কর্মী জানান, বেশ কিছুদিন ধরেই এই অবস্থা চলছে। গ্যাস এলেও চাপ খুব কম। যানবাহনের লম্বা সারির কারণ সম্পর্কে জানালেন আশপাশের অনেক সিএনজি স্টেশনেই গ্যাস না থাকায় এই স্টেশনে ভিড় করেছেন যানবাহনের চালকরা।

পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা জানান, একটি এলএনজি টার্মিনাল থেকে গড়ে ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হলেও মঙ্গলবার রাতে পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে এলএনজির সরবরাহ কমে ২৫ থেকে ২৭ কোটি ঘনফুটে নেমেছে। এতে ঢাকা ও কুমিল্লা অঞ্চলগুলোয় এলএনজির সরবরাহ বন্ধ থাকায় গ্যাস সংকট কিছুটা বেড়েছে। এর আগে মঙ্গলবার রাতে পেট্রোবাংলার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতীয় গ্যাস গ্রিডের আনোয়ারা-ফৌজদারহাট ৪২ ইঞ্চি পাইপলাইন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় জরুরি রক্ষণাবেক্ষণের কারণে মহেশখালী ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে এলএনজি সরবরাহ কমে গেছে। ফলে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি এবং তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির বিতরণ এলাকায় গ্যাসের স্বল্পচাপ বিরাজ করবে।

চট্টগ্রামের আনোয়ারা এলাকায় একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ঠিকাদারি সংস্থার পক্ষ থেকে মাটি পরীক্ষার জন্য খোঁড়াখুঁড়ির সময় আনোয়ারা-ফৌজদারহাট লাইনে ছিদ্র হয়। এতে এ পাইপলাইনে এলএনজি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাস সঞ্চালনের সংস্থা গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) প্রকৌশলীরা এটি মেরামতে কাজ করছেন।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন ও মাইনস) মো. কামরুজ্জামান খান বলেন, পাইপলাইনে ত্রুটির কারণে গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে। এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, তবে পাইপলাইন মেরামত করতে দুই থেকে তিন দিন সময় লাগতে পারে।

এদিকে তীব্র গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় ব্যাপক লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে দেশ। পিডিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) রাত ১টায় এক হাজার ৮৩৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়। আর দুপুর ১২টায় বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয় এক হাজার ৭৯৫ মেগাওয়াট। বেলা ২টায় তা আবার বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৮৯৫ মেগাওয়াট।

পিডিবির কর্মকর্তা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসভিত্তিক সব কেন্দ্র পুরো সক্ষমতায় চালাতে গেলে দিনে ২৩২ কোটি ঘনফুট গ্যাস লাগে। পেট্রোবাংলা থেকে স্বাভাবিক সময়ে সর্বোচ্চ ১১০-১১৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। তবে গতকাল তা কমে দাঁড়ায় ৭৬ দশমিক ৫২ কোটি ঘনফুটে। গ্যাস সরবরাহ এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস পাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে ধস নেমেছে। সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে ১২ থেকে সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।