Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 12:51 am

গ্যাস সাশ্রয়ে লোডশেডিংয়ে ডিজেলের অপচয়!

ইসমাইল আলী ও সাইফুল আলম: বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে জুলাইয়ের শুরুতে ডিজেলচালিত ছয় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়। যদিও পরে তা আবার চালু করা হয়। পাশাপাশি ডলার সাশ্রয়ে কমানো হয় এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি। এতে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয় সরকার। ফলে গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যায়। এর প্রভাবে ঘোষণা দিয়ে শুরু করা হয় লোডশেডিং।

আনুষ্ঠানিক ওই লোডশেডিংয়ে গ্যাস সাশ্রয় হলেও বেড়ে যায় ডিজেলের ব্যবহার। জেনারেটর চালিয়ে বিদ্যুতের চাহিদা মেটায় ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরের ধনীরা। আবার সেচেও ডিজেলচালিত জেনারেটরের ব্যবহার বেড়ে যায়। তবে এগুলোর বেশিরভাগ নি¤œমানের হওয়ায় এ খাতে ডিজেলের অপচয় হয় প্রচুর। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ডিজেলের ব্যবহার বেড়েছে ২ দশমিক ৬১ লাখ মেট্রিক টন।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, গত অর্থবছরের জুলাইয়ে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ ছিল ৩৭ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ)। আগস্টে সরবরাহ করা হয় ৩৬ দশমিক ২৯ বিসিএফ, সেপ্টেম্বরে ৩৩ দশমিক শূন্য চার বিসিএফ ও অক্টোবরে ৩৫ দশমিক ৫৪ বিসিএফ। অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ ছিল ১৪২ দশমিক ৩২ বিসিএফ।

এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে (জুলাইয়ে) বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ২০ বিসিএফ। আগস্টে সরবরাহ করা হয় ৩২ দশমিক ১৯ বিসিএফ, সেপ্টেম্বরে ৩০ দশমিক শূন্য ৫৬ বিসিএফ ও অক্টোবরে ২৮ দশমিক ৬২ বিসিএফ। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১২৩ দশমিক ৫৭ বিসিএফ।

এ হিসাবে চলতি অর্থবছর চার মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ কমানো হয়েছে ১৮ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ঘনফুট বা ১৩ দশমিক ১৭ শতাংশ। এ চার মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম গ্যাস সরবরাহ করা হয় অক্টোবরে। আর ওই মাসে লোডশেডিংও হয় সবচেয়ে বেশি। অক্টোবরে একাধিক দিন দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং করা হয়।

অন্যদিকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) হিসাবে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাইয়ে ডিজেল বিক্রির পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৯১ হাজার মেট্রিক টন, আগস্টে বিক্রির পরিমাণ ছিল তিন লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন, সেপ্টেম্বরে চার লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন এবং অক্টোবরে তিন লাখ ৫৮ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ডিজেল বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ১১ হাজার মেট্রিক টন।

আর চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে ডিজেল বিক্রির পরিমাণ ছিল চার লাখ ২২ হাজার মেট্রিক টন। আগস্টে বিক্রির পরিমাণ ছিল চার লাখ ৪৯ হাজার মেট্রিক টন, সেপ্টেম্বরে চার লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন এবং অক্টোবরে তিন লাখ ৮৯ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ডিজেল বিক্রির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টন।

এ হিসাবে চলতি অর্থবছর চার মাসে ডিজেলের বিক্রি বেড়েছে দুই লাখ ৬১ হাজার মেট্রিক টন বা ১৭ শতাংশ। এ চার মাসের মধ্যে শুধু সেপ্টেম্বরে ডিজেল বিক্রি আগের অর্থবছরের চেয়ে কিছুটা কমেছে। ওই মাসে লোডশেডিং কম হওয়ায় জেনারেটরের ব্যবহার কমে গিয়েছিল। ফলে ডিজেলের ব্যবহারও কমে যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় শুধু যে ডিজেলের ব্যবহার বেড়েছে তেমনটি নয়, ঘাটতি মেটাতে ফার্নেস অয়েলের কেন্দ্রগুলোতেও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হয়। এতে চলতি অর্থবছরের চার মাসে বিপিসিকে ফার্নেস অয়েলও এক লাখ ছয় হাজার মেট্রিক টন বেশি বিক্রি করতে হয়েছে। ফলে এলএনজি আমদানি কমিয়ে ডলার সাশ্রয়ের যে চেষ্টা সরকার করেছিল, ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল আমদানিতে তা অনেকটাই বেরিয়ে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জুলাইয়ে লোডশেডিং শুরুর পর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন পেট্রোল পাম্পে প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দেড় হাজার লিটার ডিজেল বেশি বিক্রি হতো। এগুলো ড্রামে করে বিভিন্ন অফিস ও বাসাবাড়িতে নেয়া হতো। মূলত জেনারেটরে ব্যবহারের জন্য এ তেল কিনত জনগণ। চট্টগ্রামসহ দেশের অন্য বড় শহরগুলোয়ও সে সময় খোলা ডিজেল বিক্রি বৃদ্ধি পায়।

এ বিষয়ে রাজধানীর মৎস্য ভবন মোড়ে অবস্থিত রমনা পেট্রোল পাম্পের স্বত্বাধিকারী ও বাংলাদেশ পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘জুলাইয়ে লোডশেডিং শুরুর পর থেকে পাম্পে ডিজেল বিক্রি বেড়ে যায়। আমার পাম্প থেকেই প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার লিটার ডিজেল বড় গ্যালন বা ড্রামে বিক্রি হয়েছে সে সময়। এ তেল জেনারেটরে ব্যাবহার করা হতো বিভিন্ন অফিস বা বাসাবাড়িতে।’

তিনি আরও বলেন, সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে খোলা ডিজেল বিক্রি অনেকটাই কমে আসে। সে সময় লোডশেডিংও কম ছিল। তবে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে আবার তা বৃদ্ধি পায়। আর অক্টোবরে খোলা তেল বিক্রি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কারণ ওই সময় লোডশেডিংও ছিল অনেক বেশি হারে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানোয় একদিকে যেমন গ্যাস সাশ্রয় হয়েছে, অন্যদিকে ডিজেলের মাধ্যমে জেনারেটরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে লোডশেডিং মুক্ত থেকেছে দেশের ধনীরা। আর লোডশেডিংয়ের প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। আবার লোডশেডিংয়ের কারণে তেলচালিত জেনারেটরের ব্যবহার বাড়ায় কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সুতরাং সরকারের এই বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার।

তিনি আরও বলেন, নভেম্বরে তাপমাত্রা কমায় বিদ্যুতের চাহিদা স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। ফলে এখন লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে সরকার। তিন থেকে চার মাস এ সুবিধা বহাল থাকবে। তবে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে অথবা মার্চের শুরুতে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করলে আবারও লোডশেডিং ফিরে আসবে। কারণ এ জায়গায় করণীয় এখনও বের করতে পারেনি সরকার।