Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 4:31 am

গ্রন্থস্বত্বে বঞ্চিত নবীন লেখকরা: প্রকাশকরা বলছেন দায় লেখকদেরও

জাকারিয়া পলাশ: প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয় কয়েক হাজার নতুন বই। মেলা ছাড়া অন্য সময়েও বই প্রকাশ করেন অনেকে। বিপুলসংখ্যক বই বিক্রিও হয়। এসব বইয়ের গ্রন্থস্বত্বের টাকা নিয়ে রয়েছে নানা সংশয়। লেখকদের অভিযোগ, প্রকাশকরা বইয়ের ন্যায্য পাওনা দেন না। বিশেষ করে নতুন লেখকদের নানাভাবে ঠকানোর অভিযোগ আছে। অন্যদিকে প্রকাশকদের দাবি, লেখকরাও প্রকাশকদের সঙ্গে পেশাদার আচরণ করেন না।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রকাশনাশিল্পে এ বিষয়টি এখন নৈমিত্তিক। এ নিয়ে অধিকাংশ লেখক নাখোশ হলেও বিকল্প পাচ্ছেন না তারা। নিজ খরচে বই প্রকাশের সুযোগ নেই বলেই প্রকাশকদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। আবার অনেকে এ ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। বিশিষ্টজনরা বলছেন, প্রকাশনা শিল্প হচ্ছে জ্ঞানভিত্তিক শিল্প। এর বিকাশের জন্য লেখকদের তাদের মেধাস্বত্ব নিয়ে সুনির্দিষ্ট নিয়ম করে দেওয়া উচিত। এ নিয়ে দেশে আইন ও বিধি না থাকার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকে মত দেন।

কবি ও গল্পকার রুদ্র মিজানের প্রকাশিত গ্রন্থ চারটি। তিনি বলেন, ‘প্রকাশনার অভিজ্ঞতা একদমই বাজে। সাধারণত বই বিক্রির পর লভ্যাংশের ৩০ শতাংশ লেখককে দেওয়ার নিয়ম প্রচলিত আছে। তবে এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। কিন্তু প্রকাশকরা জানতেও দেন না যে, আমার কত কপি বই প্রকাশিত হয়েছে।’

এদিকে প্রকাশকরা বলেন, নানা রকমের বই আমাদের প্রকাশ করতে হয়। তবে সব বই বিক্রি হয় না। যে বই বিক্রি হয় না, লেখককে সে বইয়ের স্বত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। তারা বলেন, অধিকাংশ লেখকই কবিতার বই প্রকাশ করতে চান। কিন্তু কবিতার বই বিক্রি হয় না। ফলে কবিতার বই প্রকাশের জন্য লেখকদের কাছে বিক্রির নিশ্চয়তা চাওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কবিতার বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রায় সব প্রকাশকই লেখকদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ নিয়ে নেন। ক্ষেত্রবিশেষে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। পরে বই প্রকাশের পর বিক্রি হলে ওই অর্থ ফেরত দেওয়া হয়। অনেকে আবার বিনা টাকায় বই প্রকাশ করেন। তবে প্রকাশের পর লেখককে বই বিক্রি করে দিতে হয়। এসব বইয়ের জন্য লেখকের রয়্যালটির অর্থ চাওয়া অবান্তর বলে মনে করেন প্রকাশকরা।

অবশ্য গল্প-উপন্যাস,  ভ্রমণকাহিনী বা গবেষণামূলক গ্রন্থের ভালো বিক্রি হয়। তরুণ লেখক রবিউল করিম মৃদুল জানান, তার দুটি গল্পগ্রন্থ ও দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে গত চার বছরে। প্রথম বইটি প্রকাশের পর আমাকে দুশোর মতো কপি সৌজন্য হিসেবে দেওয়া হয়। সেগুলো বিক্রি করে কিছু টাকা পেয়েছি। সরাসরি গ্রন্থস্বত্ব দেননি প্রকাশক। দ্বিতীয় বইটির ক্ষেত্রে প্রকাশক আমাকে বলেছেন, আমার বই বিক্রি হয়নি। কিন্তু অবিক্রীত বইগুলো বাজারে পাওয়াও যাচ্ছে না। এমনকি প্রকাশকের নিজস্ব স্টলেও বইটি নেই। এ নিয়ে প্রকাশকের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে তৃতীয় বইটি অন্য এক প্রকাশককে দিয়েছি।

প্রকাশকরা বলছেন, ভালো পাণ্ডুলিপির ক্ষেত্রে লেখকদের মূল্যায়ন করা হয়। এ প্রসঙ্গে অ্যাডর্ন পাবলিকেশনের প্রকাশক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ জাকির হোসাইন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বইয়ের রয়্যালটি দেওয়া না দেওয়ার বিষয়টি প্রকাশকের পেশাদারিত্বের বিষয়। প্রকাশকের দায়িত্ব হলো, একটি বই বাঁচিয়ে রাখা। মেলার পর অনেক বই আর বাজারে পাওয়া যায় না। এটা যেমন হওয়া উচিত নয়, তেমনি লেখকদের সঙ্গে গ্রন্থস্বত্বের বিষয়ে স্পষ্ট চুক্তি হওয়া দরকার।’

এক্ষেত্রে লেখকরাও পেশাদার নন বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘যে বই বিক্রি হয় না তার রয়্যালটি দাবি করা ঠিক নয়। তাছাড়া লেখকরা চুক্তিবদ্ধ না হয়ে কেন প্রকাশকদের বই দেন? লেখকদের বলা উচিত, রয়্যালটি না দিলে বইয়ের পাণ্ডুলিপি দেবো না।’

অনেক লেখক নানাভাবে প্রভাবিত করেও বই প্রকাশ করতে অনুরোধ করেন বলেও অভিযোগ করেন এ প্রকাশক।

এ নিয়ে রাজনীতি বিষয়ক লেখক ও গবেষক অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান শেয়ার বিজকে বলেন, দু’চারজন বিখ্যাত লেখক ছাড়া বাকি সব লেখকই প্রতারিত হচ্ছেন। লেখকস্বত্বের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এ অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। সাধারণত প্রকাশকরা বলেন, বইয়ের গায়ের মূল্যের ১৫ থেকে ১৯ শতাংশ অর্থ লেখককে দেওয়া হবে। লেখকভেদে এটা কমবেশি করে থাকেন তারা। কিন্তু প্রকাশকরা কত কপি বই ছাপিয়েছেন, তার কোনো পরিসংখ্যান লেখকদের দেন না। তারা লেখকদের সঙ্গে চুক্তিও করেন না।

এ সুযোগে প্রকাশকরা লেখকদের অজান্তে অনেক বইয়ের দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রিন্ট বের করেন। তারেক শামসুর রেহমান জানান, ‘২০১৬ সালে একটি প্রকাশনী আমার একটি পুরোনো বই নতুন প্রিন্ট করেছে। সেটি ২০১০ সালে লেখা। বইটিতে অনেক তথ্য হালনাগাদ করা নেই। এ অবস্থায়ই বইটি বাজারে ছাড়া হয়েছে। এতে একদিকে যেমন আমি আর্থিক সুবিধা পাইনি। অন্যদিকে এতে আমারই বদনাম হচ্ছে।’

এ অবস্থা চললে গবেষণা ও সৃজনশীল লেখালেখির বিকাশ সম্ভব নয় বলেও মত দেন এই অধ্যাপক। এজন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন বলেও তিনি মনে করেন।