গ্রাফিকস ডিজাইনে মিতুর অর্জন

যে কোনো উদ্যোগের শুরুতে আসে অনেক বাধাবিপত্তি। এসব গায়ে না মেখে লেগে থাকলে সফল হওয়া যায়। যারা সফল হন, তাদের অনুসরণ করলে আরও নতুন উদ্যোগ শুরু হয়। নানা খাতের সেসব সফল উদ্যোক্তাকে নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজন
গল্পটা ২০১৬ সালের। স্নাতক চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা চলছে। একই সময়ে সরকারি প্রজেক্ট ‘গ্রাফিকস ও ডিজিটাল মার্কেটিং’ এর ৫০ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণে অংশ নেন তিনি। যথারীতি পরীক্ষাও দিচ্ছেন। তবে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নিতে আধঘণ্টা আগেই পরীক্ষা হল থেকে বের হয়ে যেতেন। এভাবেই স্নাতক পরীক্ষা শেষ করেন। প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হলেন। এদিকে ৩৫ হাজার প্রশিক্ষণার্থীর মধ্য থেকে রাজশাহী জোন থেকে সর্বোচ্চ স্কোর অর্জন করেন। সেখান থেকে কাজের জন্য ২০ হাজার টাকা উপার্জন করেন। সেই টাকা দিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু করলেন বুটিকের কাজ। এভাবেই আত্মনির্ভরশীল নারী উদ্যেক্তা হয়ে উঠেন আসমা তাসনিয়া মিতু।
মিতু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে সম্প্রতি স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। বর্তমানে ‘ডেইজি’ নামের একটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অনলাইনে বুটিকের ব্যবসা করছেন। শুরুর দিকে প্রশিক্ষণ শেষ করে মিতু ভাবলেন আমি যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছি সেটাকে নিজের মতো করে প্রয়োগ করতে পারি কি-না? সে ভাবনা থেকে ফেসবুকে একটি পেজ খুলেন। নিজেই গ্রাফিকস ডিজাইনের কাজ করে, কাপড়ে ছাপ তুলে কর্মীদের কাছে পৌঁছে দেন। কর্মীরা প্রয়োজনীয় সময়ের মধ্যে ডিজাইনের কাজ শেষ করে আবার পাঠিয়ে দেন। পরে সেগুলো ওয়াশ ও লন্ড্রি শেষে প্যাক করে ক্রেতাদের কাছে পাঠানো হয়।
গ্রাফিকস ডিজাইনের কাজের আগ্রহ নিয়ে মিতু বললেন, আমি ভর্তি পরীক্ষায় চারুকলা অনুষদেও চান্স পেয়েছিলাম। কিন্তু পরিবারের ইচ্ছায় সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। ভালো লাগতো বলে ক্লাস করতাম। তবে পড়াশোনাকে ঘিরে কখনওই স্বপ্ন দেখা হয়নি। এ জন্যই স্নাতকের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিয়ে আধঘণ্টা আগে খাতা জমা দিয়ে প্রশিক্ষণের ক্লাসে অংশ নিতে চলে যেতাম। স্নাতকোত্তরে ভর্তি হওয়ার শুরু থেকে ক্লাসের ফাঁকে বাজারে চলে যেতাম, কাপড় কেনাকাটা করে আবার চলে আসতাম। রাতে ডিজাইন তৈরি করে সে ডিজাইনের ছাপ কাপড়ে তুলে পরদিন কর্মীদের কাছে পাঠিয়ে দিই।
ছোটবেলা থেকে আঁকাআঁকিতে পারদর্শী মিতু। এ আগ্রহের ওপর ভর করে বুটিকের কাজের মধ্য দিয়ে একজন নারী উদ্যোক্তা হয়ে উঠার লড়াইয়ে ছুটে চলেছেন। আঁকাআঁকি থেকে গ্রাফিকস ডিজাইনে ঝোঁক তৈরি হয় মিতুর।
শুরুতে অবশ্য গ্রাফিকসের তেমন কিছুই জানতেন না। এ জন্য রাজশাহী কলেজের কম্পিউটারে ল্যাবে প্রশিক্ষণে নিয়মিত অংশ নিতেন। নিজের আগ্রহ আর দক্ষ প্রশিক্ষকের সহযোগিতায় গ্রাফিকসের কাজ রপ্ত করে ফেললেন। এরপরে নিজের মতো করে গ্রাফিকসের কাজ শুরু করলেন। ভাবলেন, আমার এ ডিজাইন যদি কোনো প্রতিষ্ঠান কিনে নেয় তবে আমার নিজস্বতা বলে কিছুই রইলো না। পরে আম্মু ও এক বন্ধুর পরামর্শে ফেসবুকের মাধ্যমে প্রচারণা শুরু করলাম। নিজের ডিজাইনে তৈরি করা কামিজ ও শাড়ির স্যাম্পল দিয়ে।
মিতুর সহযোগী হয়ে কাজ করছেন নিম্ন-মধবিত্ত পরিবারের সাতজন (তিনজন সাঁওতাল নারী) গৃহিণী ও তিনজন কলেজ শিক্ষার্থী। তাদের অনেকেই বাসা বাড়িতে কাজ করতেন। কিন্তু মজুরি ঠিকমতো পেতেন না, আবার অসুস্থ হলে বাদ দিয়ে দিত। এছাড়া কয়েকজন গৃহিণী আছেন, যাদের স্বামী নেশাগ্রস্ত হয়ে টাকা-পয়সা নষ্ট করে ফেলেন তারাও এ কাজ করে সংসারের জন্য অবদান রাখছেন। প্রথমে তাদের ডিজাইনের সেলাইয়ের কাজ শিখিয়ে দিই, ধীরে ধীরে তারা কাজ শিখে নেয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিক্ষার্থীদের সন্ধান পেয়েছি এক আত্মীয়ের মাধ্যমে। একইভাবে তাদের কাজ শিখিয়ে দিয়েছি, এখন তারা নিয়মিত কাজ করছেন।
মিতুর বাড়ি রাজশাহীতে। রাজশাহী থেকে ডিজাইন করা কাপড় চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসে তুলে দেন সেখান থেকে কর্মীরা সংগ্রহ করে। আবার কাজ শেষ হলে সেগুলো বাসেই পাঠিয়ে দেন। শিক্ষার্থীরা এ কাজের মধ্য দিয়ে নিজেদের ছোট ছোট প্রয়োজনগুলো পূরণ করছে। মিতু বলেন, গত মাসে এক শিক্ষার্থী কলেজের পিকনিকে যাবে বলে অগ্রিম টাকা চায়। মাস যদিও শেষ হয়নি তারপরও তাকে অগ্রিম মজুরি দিয়েছিলাম, এতে করে সে খুবই খুশি হয়েছিল। কেমন লাভ হয় এমন প্রশ্নে মৃদু হাসিমাখা মিতু বললেন, আমি এখনও
মা-বাবার সঙ্গেই থাকি। নিজের মতো করে চলার হাত-খরচ উঠে আসে, এই তো অনেক।
ফেসবুক পেজে স্যাম্পল ডিজাইন ও রং পছন্দ করে দেয় ক্রেতা। সে অনুযায়ী কাপড়ে ডিজাইন করে সেলাইয়ের কাজ তুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কুরিয়ার করে। একটি নিজস্ব ওয়েবসাইট তৈরির চেষ্টা চলছে। সিলেট থেকে বেশি ক্রেতা পণ্য কেনে। এবারের ঈদে ঢাকার একটি পরিবার ৫০টি ড্রেস কিনেছে।
মিতুর ভবিষ্যৎ ভাবনা একটি কারখানা তৈরি করবে। যেখানে যেসব নারীরা বাসা বাড়িতে কাজ করার পরিবেশ পান না তাদের সুযোগ দেবেন। উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি একদিনে এ জায়গায় আসিনি। অনেক বাধা আসছে। আসলে সমাজের ধারণা পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করব আমরা। আমার আত্মীয়রা এমনটাই ভেবেছিল, কিন্তু আমি পরিবারের সহযোগিতায় তা করিনি। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছি কিন্তু সে শিক্ষাকে ধারণ করে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।

আলী ইউনুস হৃদয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০