Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 11:16 pm

গ্রামেও জমির ব্যবহার হতে হবে পরিকল্পিত

এম এ খালেক: অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে শহরে আবাসন সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহরের ৩০ শতাংশ মানুষ বস্তিতে বাস করছে। শহরে বাস করেও তারা নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এছাড়া শহরে সীমিত পরিসরে যে আধুনিক আবাসন সুবিধা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে গ্রামীণ জনগণ বঞ্চিত। ফলে আবাসন সুবিধার ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে প্রতিনিয়ত। গ্রামে আবাসন সংকট তুলনামূলকভাবে কম হলেও জোর দিয়ে বলা যাবে না, গ্রামের সব মানুষের জন্য আমরা আধুনিক সুবিধা সংবলিত আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পেরেছি। গ্রামের মানুষের জন্য বাসযোগ্য আধুনিক সুবিধা সংবলিত আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে শহর ও গ্রামের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে সমন্বয় সাধন করতে হবে। এ ছাড়া গ্রামের মানুষের জন্য কার্যকর আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে না।

বিশ্ব বসতি দিবস ২০১৭ উপলক্ষে রাজধানীতে আয়োজিত এক আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকার দেশের সব নাগরিকের জন্য আবাসন সুবিধা নিশ্চিতে কাজ করে চলেছে। তিনি আরও বলেন, শহরমুখী জনস্রোত রোধে সরকার গ্রামাঞ্চলে পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। মন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত প্রকাশ করার সুযোগ রয়েছে। গ্রামের মানুষ শুধু উন্নত আবাসন সুবিধার আশায় শহরে আসেÑএ ধারণা ঠিক নয়। কারণ সাধারণ মানুষ যদি গ্রামাঞ্চলে প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে তারা শহরে আসতে আগ্রহী হয় না। মানুষ তার নিজ জš§স্থানে অবস্থান করতেই বেশি পছন্দ করে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে বর্তমানে কর্মসংস্থানের তেমন একটা সুবিধা নেই বললেই চলে। আর যেটুকু আছে, তা দিয়ে বর্ধিত চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। গ্রামাঞ্চলে রয়েছে বিনিয়োগযোগ্য পুঁজির অভাব। এনজিওগুলো যে পুঁজি সরবরাহ করে থাকে, তার সুদহার এত বেশি যে, তা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করে সাধারণের পক্ষে অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষি ও পল্লিঋণ নামে এক ধরনের বিশেষ ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে গ্রামের সাধারণ মানুষের জন্য। এ ঋণের জন্য সুদ আরোপ করা হয় ৯ শতাংশ। শস্যঋণ ব্যতীত এটাই সর্বনি¤œ সুদহার। বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক, ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংক ও বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এ ঋণ দিচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জন্য এ খাতে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রত্যেক ব্যাংকের জন্য ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কোনো ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হলে বিতরণ করা ঋণ বাদে অবশিষ্ট অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়ে সুদবিহীন বøক অ্যাকাউন্টে রেখে দেওয়া হয়। পরবর্তী বছর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নতুন শাখা খোলার বিষয়ে সমস্যা সৃষ্টি করা হয়। এতে ব্যাংকের রেটিং খারাপ হয়ে যায়। ফলে শিডিউল ব্যাংকগুলো কৃষি ও পল্লিঋণ বিতরণে উদগ্রীব। কিন্তু ব্যাংকগুলো নিজেরা এ ঋণ বিতরণের চেয়ে এনজিওর মাধ্যমে বিতরণেই বেশি আগ্রহী। সমস্যাটি এখানেই। ব্যাংক যদি সরাসরি কৃষি ও পল্লিঋণ বিতরণ করে, তাহলে ৯ শতাংশ সুদ আরোপ করতে পারে। এনজিওদের মাধ্যমে এ ঋণ দিলে সেখানেও তারা ৯ শতাংশ সুদ আরোপ করে; কিন্তু এনজিওগুলো কৃষক পর্যায়ে এ ঋণে ২৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আরোপ করে। তার অর্থ হচ্ছে, কৃষি ও পল্লিঋণ বিতরণের মাধ্যমে ব্যাংকসহ এনজিওগুলো লাভবান হচ্ছে; কিন্তু টার্গেট গ্রæপ যে কৃষকÑতারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাহলে এ ধরনের বিশেষ ঋণ বিতরণের প্রয়োজন কী?

গ্রামের মানুষের জন্য শুধু নয়, দেশের সব নাগরিকের জন্য আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বাসযোগ্য আবাসন সুবিধাপ্রাপ্তি একজন নাগরিকের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। তাই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এ কাজটি করতেই হবে। অন্যথায় রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবে। শহরাঞ্চলে কিছুটা হলেও পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। এটা গড়ে উঠছে মূলত বেসরকারি বা ব্যক্তি উদ্যোগে। গ্রামাঞ্চলে কিন্তু এখনও পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ-আয়োজন লক্ষ করা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এ ব্যাপারে তেমন কোনো চিন্তা-ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। শহরে যেমন পরিকল্পিত আবাসন সুবিধা গড়ে তোলা দরকার, তেমনি গ্রামাঞ্চলেও এটা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ অর্থনৈতিকভাবে গ্রামের তুলনায় শহর এগিয়ে থাকলেও বসবাসের দিক থেকে গ্রাম এখনও অনেক গুরুত্ববাহী। বিভিন্ন জরিপে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যার শ্রেণিবিন্যাস বড়ই বিচিত্র। মোট জনসংখ্যার ৭২ শতাংশ এখনও গ্রামে বাস করে। অবশিষ্ট ২৮ শতাংশ শহরে। শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই আবার রাজধানীতে বাস করে। ফলে ঢাকা শহরে বস্তির সংখ্যা অন্যান্য শহরের তুলনায় অনেক বেশি। মোট জনসংখ্যার ৭২ শতাংশ গ্রামে বাস করলেও আবাসন সুবিধার সংখ্যাতাত্তি¡ক বিবেচনায় তারা উপরে রয়েছে; যদিও সেই আবাসন সুবিধার প্রায় পুরোটাই অপরিকল্পিত। দেশের মোট আবাসন সুবিধা বা গৃহের ৮১ শতাংশই গ্রামাঞ্চলে। অর্থাৎ শহর ও গ্রামীণ গৃহের অনুপাতে গ্রাম ভালো অবস্থানে রয়েছে। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, গ্রামে শহরের তুলনায় গৃহের সংখ্যা বেশি হলেও তাদের অবস্থা মোটেও সুবিধাজনক নয়। গ্রামাঞ্চলে যেসব গৃহ রয়েছে, তার ৮০ শতাংশই নি¤œমানের অবকাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। এগুলোকে সত্যিকার অর্থে আবাসন সুবিধা বলা যায় না। মানুষ কোনোমতে ওইসব বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে দিনাতিপাত করছে। এখানে আরও একটি বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়, তা হলোÑএখনও গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ মানুষ বাস করলেও তারা দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে তুলনামূলক কম অবদান রাখছে। মোট জিডিপিতে শহরের অবদান ৬০ শতাংশের মতো। আর ৪০ শতাংশ অবদান গ্রামীণ অর্থনীতির। আগে শহর থেকে পুঁজি গ্রামের দিকে ধাবিত হতো। এখন গ্রাম থেকে শহরে সঞ্চারিত হয়। একসময় পূর্ববঙ্গ থেকে যেমন জমিদারি পুঁজি পশ্চিমবঙ্গে যেত; ঠিক তেমনি এখন গ্রাম থেকে পুঁজি শহরে সঞ্চারিত হয়। প্রায় এক কোটি মানুষ বিদেশে কর্মসংস্থানে নিয়োজিত। এদের ৯০ শতাংশই গ্রামাঞ্চলের সাধারণ শ্রমিক শ্রেণি। তারা যে টাকা দেশে প্রেরণ করেন, তা স্থানীয় বেনিফিশিয়ারিরা ভোগ-বিলাসে ব্যয় করেন। এই ভোগ-বিলাসের উপকরণ আসে শহর থেকে। ফলে তাদের পুঁজি গ্রাম থেকে শহরে চলে যায়। অথচ প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ গ্রামে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ যদি নিশ্চিত করা যেত, তাহলে গ্রাম থেকে পুঁজি শহরমুখী হতো না। পানির স্বাভাবিক ধর্ম যেমন নিচের দিকে ধাবিত হওয়া, তেমনি পুঁজির প্রবণতা হচ্ছে তুলনামূলক লাভজনক গন্তব্যের দিকে যাওয়া। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রবাসীরা যে অর্থ দেশে প্রেরণ করেন, তার মাত্র ২৫ শতাংশ বিনিয়োগ হয়। এ বিনিয়োগও সরাসরি উৎপাদনশীল খাতে হয় না। বাড়িঘর নির্মাণ, রেডিও-টেলিভিশন-ফ্রিজ প্রভৃতি কেনার জন্যই এ টাকা ব্যয়িত হয়। এগুলোর প্রায় সবই তৈরি হয় শহরে। কাজেই টাকা চলে আসে শহরে।

গ্রামাঞ্চলের জন্য সঠিক ও আধুনিক ভ‚মি ব্যবহার এবং বাড়ি নির্মাণ নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। গ্রামে বাড়িঘর তৈরির কোনো সঠিক নিয়ম নেই। যার যেভাবে ইচ্ছা নির্মাণ করছেন। ভ‚মি ব্যবহার করছেন। অনেকে অকারণে জমি অনাবাদি রেখে দিচ্ছেন। যেখানে-সেখানে অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর নির্মাণের ফলে প্রতি বছর ২৩৫ হেক্টর কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে আবাদযোগ্য জমি খুঁজে পাওয়া যাবে না। শহরে যেমন একটি বাড়ি নির্মাণ করতে রাজউকের অনুমোদন প্রয়োজন, তেমনি গ্রামে বাড়ি করতে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদনের বিধান করা যেতে পারে। দেখা যায়, কোনো একটি পরিবার বিভক্ত হয়ে গেলে প্রত্যেক পরিবার চেষ্টা করে কীভাবে আলাদাভাবে বাড়ি তৈরি করা যায়। এ প্রবণতা আইন দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে একাধিক ঘর তৈরি না করে ফ্ল্যাট পদ্ধতিতে করা যেতে পারে। কোনো পরিবারে তিন ভাই থাকলে তাদের তিনটি বাড়ি নির্মাণের অনুমতি না দিয়ে বরং একই ভিত্তির ওপর তিনতলা ভবন নির্মাণ করে সেখানে ফ্ল্যাট পদ্ধতিতে বসবাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। জমি হচ্ছে উৎপাদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। একবার কোনো জমি বাড়িঘর নির্মাণের জন্য ব্যবহার হলে তা আর কখনই ফসল উৎপাদনের কাজে লাগানো যায় না। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ২০০৭-০৮-এর বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ মন্দার কথা। বাংলাদেশের ওপর সে মন্দার প্রভাব তেমন একটা পড়েনি। কারণ সে বছরও দেশে প্রচুর খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল। কিন্তু যেসব দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন হয়নি, তারা ভয়াবহ বিপাকে পড়েছিল। টাকা দিয়েও প্রয়োজনীয় খাদ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক অঞ্চলে খাদ্যের জন্য দাঙা বেঁধে গিয়েছিল। ভবিষ্যৎ ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদার কথা মাথায় রেখে এখন থেকেই পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। উচ্চ ফলনশীল ও বছরে তিন বা চারবার ফলন পাওয়া যায়Ñএমন ফসলের বীজ উদ্ভাবন করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে ‘ব্রিকফিল্ড’ তৈরির জন্য যাতে ফসলি জমি ব্যবহার করা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। একবার ব্রিকফিল্ড নির্মাণ হলে সে জমিতে আর কখনই ভালো ফসল হয় না। গ্রামাঞ্চলে অনেক পুকুর-ডোবা পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। সেগুলোকে পরিকল্পিতভাবে আবাদের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এছাড়া মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করে কোন এলাকায় কোন ফসল ভালো হয়Ñতা নির্ণয় করে ‘ক্রপ জোনিং’ করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে অপ্রতিহত গতিতে; কিন্তু জমির জোগান প্রতিনিয়ত কমতে থাকবে। তাই আগামী ১০০ বা ২০০ বছরকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা করতে হবে। আমরা শহরকে উন্নত করব বা শহরের ওপর গুরুত্ব দেব; তাই বলে গ্রামকে অবজ্ঞা করে নয়। শহরে স্থাপিত শিল্প-কারখানার কাঁচামালের জোগান আসবে গ্রাম থেকে। গ্রামের অর্থনৈতিক গুরুত্ব তাই কখনই হ্রাস পাবে না।

 

অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক