নিজস্ব প্রতিবেদক: গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে ১১৭ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছিল গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো। তবে সে প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করে গড়ে ২০ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে বিইআরসির (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) কারিগরি কমিটি। যদিও এটিই চূড়ান্ত হার নয়। তবে সুপারিশটি বাস্তবায়ন হলে গ্যাসের মূল্য গড়ে বাড়বে প্রতি ঘনমিটারে এক টাকা ৯৪ পয়সা। এতে গ্রাহকদের ব্যয় বাড়বে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ওপর অনুষ্ঠিত চার দিনের গণশুনানি বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ২১-২৪ মার্চ রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। যদিও শুনানিতে প্রতিদিনই দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিরোধিতা করে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। আর বিতরণ কোম্পানিগুলোর অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবকে সন্তোষজনক নয় বলে মনে করছে বিইআরসি।
শুনানিতে কারিগরি কমিটি জানায়, চলতি (২০২১-২২) অর্থবছর গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাস সরবরাহের সম্ভাব্য পরিমাণ দাঁড়াবে তিন হাজার ৮৬ কোটি ৫৮ লাখ ঘনমিটার। এজন্য ব্যয় হবে প্রায় ৪৯ হাজার ১২৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এতে ইউনিটপ্রতি ব্যয় পড়বে ১৫ টাকা ৯২ পয়সা।
গ্যাস সরবরাহে এ ব্যয়ের মধ্যে ঘাটতি মেটাতে অনুদান, সরকারের ভর্তুকি ও কোম্পানিগুলোর অবণ্টিত মুনাফা থেকে মোট ১৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যবহার করা হবে। এর মধ্যে জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল (ইএফএস) থেকে দেয়া হবে চার হাজার কোটি টাকা। গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর অবণ্টিত মুনাফা থেকে ছয় হাজার ২০০ কোটি টাকা নেয়া হবে। আর সরকার ভর্তুকি দেবে তিন হাজার কোটি টাকা।
এদিকে গ্রাহকদের কাছে গ্যাস বিক্রি করে চলতি অর্থবছর পাওয়া যাবে ৩৫ হাজার ৯২৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ভর্তুকি, অনুদান ও ইএফএস বাদ দেয়ার পর ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম পড়বে ১১ টাকা ৬৪ পয়সা। আর বর্তমানে গ্যাসের মূল্যহার ৯ টাকা ৭০ পয়সা। এতে ঘাটতি থাকে এক টাকা ৯৪ পয়সা। এ ঘাটতি মেটাতে গড়ে ২০ শতাংশ হারে মূল্য বৃদ্ধি করতে হবে।
কারিগরি কমিটির বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদ্যমান দামে সরবরাহকৃত গ্যাস বিক্রি করা হলে গ্রাহকদের মোট ব্যয় হতো ২৯ হাজার ৯৩৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। তবে দাম ২০ শতাংশ বাড়ালে ব্যয় পড়বে ৩৫ হাজার ৯২৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অর্থাৎ গ্রাহকের মোট ব্যয় বাড়বে পাঁচ হাজার ৯৮৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
যদিও গণশুনানিতে দাম বৃদ্ধির সুপারিশের বিরোধিতা করেন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘গ্যাস কোম্পানিগুলো প্রচুর মুনাফা করছে। সরকারকে উদ্বৃত্ত টাকা দিচ্ছে। উন্নয়নকাজের জন্য গ্রাহকের পকেট থেকে এখনই গ্যাসের দামের সঙ্গে গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের নামে টাকা কেটে রাখা হচ্ছে। এই অবস্থায় কোম্পানিগুলোর গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অগ্রহণযোগ্য। তারা ব্যবসা করার নামে গ্রাহকের টাকা দিয়ে যাচ্ছেতাই করছে।’
এদিকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবগুলো সন্তোষজনক নয় বলে দাবি করেন বিইআরসির চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল। শুনানি শেষে গতকাল তিনি বলেন, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো মূল্যহার ও বিতরণ মার্জিন বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। তবে সমাজে এর প্রভাব কী হবে, তা বিশ্লেষণ করেনি। গ্রাহকদের ওপর গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব কতটা পড়বে, তা বিশ্লেষণ করেনি।
তিনি আরও বলেন, পেট্রোবাংলা গ্যাসের দাম বৃদ্ধির যে প্রস্তাবটি দিয়েছে, তা যৌক্তিকতা, ন্যায্যতা ও বাস্তবতার নিরিখে সন্তোষজনক নয়। এটাকে সন্তোষজনক পর্যায়ে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। প্রস্তাবটি চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হবে। তা গ্রহণযোগ্য, ন্যায্য ও যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পোস্ট শুনানিতে প্রয়োজনে বিভিন্ন পক্ষকে পুনরায় ডাকা হবে।
প্রসঙ্গত, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির মূল কারণ স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা। এক্ষেত্রে প্রতি হাজার ঘনফুট এলএনজির দাম পড়বে ২৪ দশমিক ১৯ ডলার। যদিও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় রি-গ্যাসিফাইড এলএনজির প্রতি হাজার ঘনফুটের দাম পড়ছে ১২ দশমিক ২৬ ডলার। আবার এলএনজির ওপর আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও সাত শতাংশ উৎসে কর আদায় করা হয়। আর এলএনজিকে রি-গ্যাসিফাইড করতে হয়।
সব মিলিয়ে প্রতি ঘনমিটার এলএনজির আমদানি ব্যয় পড়ে ৪৮ টাকা আট পয়সা। আর দেশীয় উৎপাদিত গ্যাসের দাম পড়ে দুই টাকা ১৫ পয়সা। তবে মিশ্রিত গ্যাসের দাম পড়ে ১২ টাকা ৪৭ পয়সা। এর সঙ্গে সঞ্চালন ও বিতরণ চার্জ এবং গ্যাস বিক্রির সময় গ্রাহক পর্যায়ে আরও ১৫ শতাংশ ভ্যাট যোগ করা হয়। এছাড়া গ্যাস উন্নয়ন তহবিল ও জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল বাবদ ব্যয় যোগ হয়। এর সঙ্গে চলতি অর্থবছর থেকে জ্বালানি গবেষণা তহবিল গঠন বাবদ একটি অংশও যোগ হবে। সব মিলিয়ে গ্যাস সরবরাহ ব্যয় পড়বে প্রতি ঘনমিটার ১৫ টাকা ৯২ পয়সা।
এলএনজির প্রসঙ্গে বিইআরসি চেয়ারম্যান বলেন, এলএনজিকে বিকল্প পন্থায় কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, তা বিবেচনা করে দেখা হবে। এজন্য সব পক্ষের মতামত নেয়া হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত এলএনজির বিকল্প পাওয়া যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটির বিকল্প ব্যবহার করা হবে। যদি দেখা যায় একান্তভাবেই কোনো বিকল্প পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে এলএনজি গ্রহণ করা হবে। সেক্ষেত্রে যেটুকু দাম না বাড়ালেই নয়, ততটুকুই বাড়ানো হবে।
বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘শুনানিতে জনগণের প্রত্যাশা আপনারা জেনেছেন। আবার আপনাদের প্রত্যাশা আমরা জেনেছি। এই দুই প্রত্যাশার মধ্যে সমন্বয় করার চেষ্টা করা হবে। যদি আপনাদের কিছু না দিয়ে পারা যায় তাহলে তা দেখা হবে। আর যদি একান্তই দিতে হয় তাহলে সর্বনিন্ম পর্যায়ে দেয়ার চেষ্টা করা হবে, যাতে ভোক্তাদের কষ্ট না হয়।’
যদিও অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, গ্যাসের মূল্যহার নির্ধারণে সব খাতের ব্যয় যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি। যেমন বিইআরসির আইন অনুযায়ী কোম্পানিগুলো মুনাফায় পরিচালনার সুযোগ নেই; যা ব্যয় তাই আয় ধরে তাদের বিতরণ মার্জিন নির্ধারণ করা উচিত। অথচ তাদের বিতরণ মার্জিন দরকার না থাকা সত্ত্বেও ২৫ পয়সা করে দেয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সরকার লিখিতভাবে জানায়নি তিন হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেবে। বরং বিইআরসির আগের নির্দেশনা অনুযায়ী সাত হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা ভর্তুকি সরকারের দেয়ার কথা। সেটা ধরেই হিসাব করা উচিত ছিল। সেটা করা হয়নি বরং করোনার সময় সরকার করুণা একটু বেশি করবে এমনটাই প্রত্যাশা। এগুলো সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে মূল্যহার না বেড়ে উল্টো কমানোর কথা।
তথ্যমতে, কারিগরি কমিটি রান্নার জন্য দুই চুলার সংযোগে বিল ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৮০ টাকা ও এক চুলার বিল ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৯০ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে। আর মিটারযুক্ত আবাসিক গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটারের গ্যাস দাম বর্তমানে ১২ টাকা ৬০ পয়সা। তা বাড়িয়ে ১৮ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়।
এর বাইরে বৃহৎ শিল্পে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১২ টাকা ৬৯ পয়সা ও মাঝারি শিল্পে ১২ টাকা ৪৯ পয়সা নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়। তবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৭ টাকা চার পয়সা থেকে কমিয়ে ১১ টাকা ৪৯ পয়সা নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে। ক্যাপটিভে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম (শিল্পকারখানায় নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাস) ১৩ টাকা ৮৫ পয়সার স্থলে ১৫ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়।
এদিকে চা বাগানে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১২ টাকা ৬৫ পয়সা, হোটেল-রেস্টুরেন্টে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৭ টাকা ৬০ পয়সা এবং সিএনজির দাম ৪৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৯ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে কারিগরি কমিটি। আর বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার চার টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে পাঁচ টাকা ৩৪ পয়সা নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়।
গ্রাহকদের খরচ বাড়বে ৬০০০ কোটি টাকা
