Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 11:34 am

‘গ্রাহকশূন্য’ সিটিসেল!

পলাশ শরিফ: গ্রাহকশূন্য হয়ে পড়েছে দেশের প্রথম সেলফোন অপারেটর কোম্পানি ‘সিটিসেল’। লাইসেন্স নবায়ন ও বেতার তরঙ্গ ফি বকেয়ার জেরে গত বছর অক্টোবরে ১৭ দিন সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় বিকল্প বেছে নিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ গ্রাহকরা। ক্রমে হাতছাড়া হয়ে যায় করপোরেট গ্রাহকরাও। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের আদেশে তরঙ্গ ফিরে পেলেও এখন প্রাণে আগের সেই স্পন্দন নেই।
বিটিআরসির তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালের জুলাইয়ে সিটিসেলের গ্রাহকসংখ্যা ছিল ছয় লাখ ৬৮ হাজার। প্রযুক্তিগত দুর্বলতা, তীব্র প্রতিযোগিতা আর বকেয়া ইস্যুতে যে কোনো সময় বন্ধের ঝুঁকির কারণে আগস্ট পর্যন্ত এক মাসে প্রায় পাঁচ লাখ গ্রাহক হারায় প্রতিষ্ঠানটি। আগস্ট শেষে সিটিসেলের গ্রাহকসংখ্যা এক লাখ ৪২ হাজারে দাঁড়ায়। তবে আগস্টের শেষ দিনে বিটিআরসির বন্ধের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর গ্রাহক কমতে শুরু করে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে গ্রাহক সংকটে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। সংকট এতটা প্রকট যে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকেও গ্রাহকসংখ্যা সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছে না সিটিসেল। তাই বিটিআরসির দেওয়া গত সেপ্টেম্বরের সেলফোন গ্রাহক পরিসংখ্যানে সিটিসেলের কোনো তথ্যই নেই। আর এর পরের মাসের (অক্টোবর) পরি-সংখ্যানে সিটিসেলের গ্রাহকসংখ্যার স্থলে চারটি শূন্য (০,০০০) দৃশ্যমান।
জানতে চাইলে বিটিআরসি কিংবা সিটিসেল কর্তৃপক্ষ কেউই এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, সিটিসেলের বর্তমান গ্রাহকসংখ্যা সম্পর্কে বিটিআরসির কাছেই সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। গত বছরের আগস্টে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকে বিটিআরসিকেও গ্রাহকসংখ্যা সম্পর্কে কোনো তথ্য দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। যোগাযোগ করার জন্য বিটিআরসির কাছে থাকা অফিসিয়াল সেলফোন নম্বরগুলোও বন্ধ। তাই সিটিসেলের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে বিটিআরসি কর্মকর্তারাও যোগাযোগ করতে পারছেন না। আর সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় সর্বশেষ প্রকাশিত পরিসংখ্যানে শূন্য রাখা হয়েছে। তবে যদি কোনো গ্রাহক থাকেন ও প্রতিষ্ঠানটি যদি বিটিআরসিকে জানায়, তাহলে পরবর্তীতে তা তুলে ধরবে সংস্থাটি। তবে সিটিসেলের পক্ষ থেকে কিছু জানার আগে সংস্থাটির দায়িত্বশীলরা এ বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি।
এদিকে গ্রাহকশূন্যতার কারণ জানতে গিয়ে মিলেছে আরও বেশকিছু তথ্য। নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, নতুন বিদেশি বিনিয়োগের ওপর ভর করেই পাওনা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সিটিসেল। এর জেরে তরঙ্গও ফিরে পেয়েছে। তবে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে অনিশ্চয়তায় গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বশীল অনেকেই সিটিসেল ছেড়েছেন। দক্ষ জনবল আর গ্রাহকের আস্থা হারিয়ে এতে দুর্বল হয়ে পড়েছে নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাও। প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীল শীর্ষ কর্মকর্তাদের সিটিসেল নম্বরগুলোতেও এখন ‘নেটওয়ার্ক ফেইল’ দেখাচ্ছে। একইভাবে সিটিসেলের গ্রাহকসেবা কেন্দ্রের (০১১৯৯১২১১২১) নম্বরেও সংযোগ মিলছে না। খোদ সিটিসেলের দায়িত্বশীলরাই বিকল্প হিসেবে অন্য অপারেটরের সেলফোন নম্বর ব্যবহার করছেন বলে জানা যায়।
গ্রাহকশূন্যতা সম্পর্কে জানতে সিটিসেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহবুব চৌধুরীসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সিটিসেল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে সেগুলো প্রথমে ‘নেটওয়ার্ক ফেইল’ দেখায়। গ্রাহকসেবা কেন্দ্রের নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া গেছে। প্রধান কার্যালয়ে দফায় দফায় যোগাযোগ করা হলেও দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যায়নি।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, প্রযুক্তিগত কারণে পিছিয়ে পড়া দেশের প্রথম সেলফোন অপারেটর প্রতিষ্ঠান সিটিসেলের সংকট গত বছরের আগস্টে প্রকট রূপ নেয়। লাইসেন্স ও বেতার তরঙ্গ ফি বাবদ প্রায় ৪৭৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা বকেয়ার অভিযোগে ৩১ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকদের বিকল্প বেছে নিতে সিটিসেল গ্রাহকদের উদ্দেশে গণবিজ্ঞপ্তি দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। এরপর ১৭ আগস্ট সিটিসেলের লাইসেন্স বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। লাইসেন্স বাতিল বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে নোটিসও পাঠিয়েছিল বিটিআরসি। নানা টানাপড়েনের পর ২০ অক্টোবর সিটিসেলের তরঙ্গ স্থগিত করে সংযোগ বন্ধ করে দেয় বিটিআরসি। এর জেরে ১৭ দিন বন্ধও ছিল সিটিসেল। পাওনা পরিশোধের শর্তে পরে উচ্চ আদালতের আদেশে ৬ নভেম্বর প্রাণ ফিরে পায় প্রতিষ্ঠানটি। তবে টানাপড়েনের ফাঁদে গ্রাহক হারিয়েছে সিটিসেল। সর্বশেষ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পুলিশসহ বড় করপোরেট গ্রাহকরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তাই প্রাণ ফিরলেও সেই প্রাণের স্পন্দন ‘গ্রাহক’ হারাতে বসেছে সিটিসেল। উল্লেখ্য, সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি সিংটেল এশিয়া প্যাসিফিক ইনভেস্টমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেডের কাছে সিটিসেলের ৪৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। বাকি শেয়ারের মধ্যে ৩৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ প্যাসিফিক মোটরস লিমিটেড ও ১৭ দশমিক ৫১ শতাংশের মালিকানা ফারইস্ট টেলিকমের। ২০১২ সালে কোম্পানিটির সিংহভাগ শেয়ারের মালিক সিংটেল নতুন বিনিয়োগ বন্ধ করে দেওয়ায় আর্থিক সংকটে পড়ে সিটিসেল। ২০১০ সালের অক্টোবরে কোম্পানিটির সর্Ÿোচ্চ গ্রাহক ছিল ১৯ লাখ ৩৩ হাজার, যা গত বছরের অক্টোবর শেষে শূন্যের কোঠায় নেমেছে। অন্যদিকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রায় ৪৮০ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে সিটিসেল।