নিজস্ব প্রতিবেদক: পাইকারি, খুচরা ও সঞ্চালন তিন ক্ষেত্রেই বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ল; এর ফলে ভোক্তাদের প্রতি মাসে গুনতে হবে বাড়তি টাকা। এর মধ্যে সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে (খুচরা) প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৬ পয়সা বা পাঁচ দশমিক তিন শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে প্রতি ইউনিটের দাম ছয় টাকা ৭৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে সাত টাকা ১৩ পয়সা।
এদিকে পাইকারিতে (বাল্ক) বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট গড়ে ৪০ পয়সা বা আট দশমিক চার শতাংশ বেড়েছে। এতে চার টাকা ৭৭ পয়সা থেকে বেড়ে প্রতি ইউনিটের বাল্ক বিদ্যুতের দাম হয়েছে পাঁচ টাকা ১৭ পয়সা। এছাড়া বিদ্যুৎ সঞ্চালন মূল্যহার বা হুইলিং চার্জ প্রতি ইউনিটে শূন্য দশমিক ২৭৮৭ টাকা থেকে পাঁচ দশমিক তিন শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছে শূন্য দশমিক ২৯৩৪ টাকা।
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির এ ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল। তিনি বলেন, মার্চ থেকে এ দাম কার্যকর হবে।
এর আগে সর্বশেষ ২০১৭ সালের নভেম্বরে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৫ পয়সা বা পাঁচ দশমিক তিন শতাংশ বাড়ায় সরকার, যা ওই বছর ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। তবে সেবার পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে উল্টো কিছুটা কমানো হয়েছিল।
তথ্যমতে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০১০ সালের মার্চ থেকে এ নিয়ে নবম বার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। গত বছরের জুনের শেষে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দুই মাসের মাথায় বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ানোর জন্য বিইআরসিতে প্রস্তাব পাঠাতে শুরু করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। এসব প্রস্তাবের ওপর গত ২৮ নভেম্বর শুরু হয় গণশুনানি।
সে সময় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) পাইকারিতে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ২৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। তাছাড়া বিতরণকারী বা খুচরা বিক্রেতা সংস্থা বিপিডিবি ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) এবং চার কোম্পানি ডেসকো, ডিপিডিসি, ওজোপাডিকো ও নেসকো গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর আবেদন করে। যুক্তি হিসেবে পরিচালন ও জনবল বাবদ ব্যয় বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তি স্থাপন ও সরঞ্জামের মূল্য বৃদ্ধির কথা বলা হয় কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে। পাশাপাশি সঞ্চালন মাশুল বৃদ্ধির প্রস্তাব করে পিজিসিবি।
নিয়ম অনুযায়ী, গণশুনানির ৯০ দিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত জানাতে হয় বিইআরসিকে। ৯০ দিন পূর্ণ হওয়া এক সপ্তাহ আগেই দাম বৃদ্ধির ঘোষণা এলো।
কমিশনের আদেশমতে, আবাসিকের লাইফ লাইন গ্রাহকদের (শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী) প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম করা হয়েছে তিন টাকা ৫০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে তিন টাকা ৭৫ পয়সা। আর সাধারণ গ্রাহকদের ক্ষেত্রে প্রথম ধাপে শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম চার টাকা থেকে বাড়িয়ে চার টাকা ১৯ পয়সা, দ্বিতীয় ধাপে ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিটের জন্য পাঁচ টাকা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা ৭২ পয়সা, তৃতীয় ধাপে ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ৫ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা, চতুর্থ ধাপে ৩০১ থেকে ৪০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৩৪ পয়সা, পঞ্চম ধাপে ৪০১ থেকে ৬০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ৯ টাকা ৩০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৯৪ পয়সা এবং ষষ্ঠ ধাপে ৬০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিটে ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১১ টাকা ৪৬ পয়সা করা হয়েছে।
এবারই প্রথমবারের মতো বৈদ্যুতিক ব্যাটারি চার্জিং স্টেশনের জন্য বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করেছে কমিশন। এই স্টেশনে চার্জিংয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম অফপিক সময়ের জন্য ৬ টাকা ৮৮ পয়সা, সুপার অফপিক সময়ের জন্য ৬ টাকা ১১ পয়সা, পিক সময়ের জন্য ৯ টাকা ৫৫ পয়সা এবং ফ্ল্যাট রেটে ৭ টাকা ৬৪ পয়সা নির্ধারণ করেছে কমিশন।
কৃষিকাজে বা সেচে বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ১৬ পয়সা করা হয়েছে। আর ক্ষুদ্রশিল্প প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুতের দাম অফপিক ৭ টাকা ৩৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ৬৮ পয়সা, পিক সময়ে ৯ টাকা ৮৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা ২৪ পয়সা, আর ফ্ল্যাট দরের ক্ষেত্রে ৮ টাকা ২০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ৫৩ পয়সা করা হয়েছে।
এদিকে শিল্প খাতে মধ্যম চাপ (১১ কেভি) বিদ্যুতের দাম ফ্ল্যাট ৮ টাকা ১৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ৫৫ পয়সা, অফপিক সময়ে ৭ টাকা ৩৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ৭০ পয়সা, আর পিক সময়ের ক্ষেত্রে ১০ টাকা ১৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা ৬৯ পয়সা করা হয়েছে। একইভাবে উচ্চচাপ (৩৩ কেভি) ও অতি উচ্চচাপ (১৩২ কেভি ও ২৩০ কেভি) গ্রাহকদের বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে।
অন্যান্য খাতের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম আগের হারই বলবত আছে। এক্ষেত্রে ফ্ল্যাট রেইট ১০ টাকা ৩০ পয়সা, অফপিক সময়ে ৯ টাকা ২৭ পয়সা এবং পিক সময়ের জন্য ১২ টাকা ৩৬ পয়সা প্রতি ইউনিটের দামই আছে।
সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের চেয়ারম্যান আবদুল জলিল বলেন, ‘দাম বাড়ানোর জন্য কমিশন যেসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েছে, তার মধ্যে আমদানিকৃত কয়লার ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট ধার্য, ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ বৃদ্ধি, অবচয় ব্যয় বৃদ্ধি, তুলনামূলক কম মূল্যে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ ক্রয় এবং এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সির অর্থায়নে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছিল সেগুলোর সুদ পরিশোধ এবং প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দামের ওপর ১০ পয়সা হারে ডিমান্ড চার্জ আরোপ করা। এসব বিষয় বিবেচনা করে দাম বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এই দাম মার্চ মাস থেকে কার্যকর হবে এবং পরবর্তী আদেশ না হওয়া পর্যন্ত এই আদেশ কার্যকর থাকবে।’
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেশিরভাগ শুনানির পর বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। তবে কখনও কখনও পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি। ২০১০ সালের ১ মার্চ গ্রাহক পর্যায়ে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়েছিল। সেবার পাইকারিতে বাড়েনি। ২০১১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গ্রাহক পর্যায়ে ৫ শতাংশ এবং পাইকারিতে ১১ শতাংশ বেড়েছিল। ২০১১ সালের ১ আগস্ট গ্রাহক পর্যায়ে বাড়েনি। তবে পাইকারিতে ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ বাড়ানো হয়। ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর গ্রাহক পর্যায়ে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং পাইকারিতে ১৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ বাড়ানো হয়। ২০১২ সালের ১ সেপ্টেম্বর গ্রাহক পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং পাইকারিতে ১৭ শতাংশ, ২০১৫ সালের ১ আগস্ট গ্রাহক পর্যায়ে ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। সেবার পাইকারিতে বাড়েনি। এরপর সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১ ডিসেম্বর গ্রাহক পর্যায়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। সেই সময়ও পাইকারিতে দাম বাড়েনি।
গতকাল ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ভবনে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের সদস্য মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী, রহমান মুরশেদ, মোহাম্মদ আবু ফারুক ও মোহাম্মদ বজলুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।