Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 3:37 am

গ্রিড বিপর্যয়ে এক ঘণ্টায় বন্ধ হয়ে যায় ৮৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র

ইসমাইল আলী:মঙ্গলবার বেলা ২টা চার মিনিটে জাতীয় গ্রিডের পূর্বাঞ্চলে আকস্মিক বিপর্যয় নেমে আসে। এতে দেশের চারটি বিভাগ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। চার ঘণ্টা পুরোপুরি বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল ২৮টি জেলায়। বিপর্যয়ের কারণে পূর্বাঞ্চল গ্রিডে বিদ্যুৎ উৎপাদন নেমেছিল শূন্যের কোঠায়। সে সময় এক ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় ৮৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। তবে বিপর্যয়ের চার ঘণ্টায়ও বেশিরভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা যায়নি।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) ও ন্যাশনাল লোড ডেসপাচ সেন্টারের (এনএলডিসি) মঙ্গলবারের বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি বিশ্লেষণে এ তথ্য পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, পূর্বাঞ্চলের গ্রিড বিপর্যয়ে উৎপাদনে থাকা ৮২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র এক ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। আর পূর্বাঞ্চলের ধাক্কায় পশ্চিমাঞ্চল গ্রিডেরও তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বেলা ২টা থেকে ৩টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। এতে মাত্র এক ঘণ্টায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গিয়েছিল সাত হাজার ১৭৬ মেগাওয়াট।

পূর্বাঞ্চল গ্রিড বিপর্যয়ের এ ধাক্কা সহজে কাটিয়ে ওঠা যায়নি। বিপর্যয় শুরুর এক ঘণ্টার মধ্যে পূর্বাঞ্চল গ্রিডে বিদ্যুৎ উৎপাদন শূন্য হয়ে যায়। সে সময় শুধু ভারতের ত্রিপুরা থেকে আমদানিকৃত ১৬৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছিল। বিপর্যয়-পরবর্তী দুই ঘণ্টায় মাত্র ১৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র সীমিত আকারে চালু করা যায়। এ সময় পূর্বাঞ্চল গ্রিডে যুক্ত হয় মাত্র ৪৩২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

বিপর্যয়ের দুই ঘণ্টার মধ্যে উৎপাদনে আসে সরকারি পাঁচটি ও বেসরকারি আটটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর মধ্যে পিডিবির অধীন আশুগঞ্জ ১৯৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির ৩৬ মেগাওয়াট ও ৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির ২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন শুরু হয়। একইভাবে ২২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার ঘোড়াশাল ইউনিট-৪ কেন্দ্রটির ১২ মেগাওয়াট, আরপিসিএল ২১০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির ১৬ মেগাওয়াট এবং ময়মনসিংহের সুতাইখালী ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৯ মেগাওয়াট উৎপাদন শুরু হয় ওই সময়ে।

বেসরকারি মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে দুই ঘণ্টার মধ্যে উৎপাদনে আসে শাহজীবাজার ৮৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৬ মেগাওয়াট, টাঙ্গাইলের ডরিনের ২২ মেগাওয়াট কেন্দ্রের ১১ মেগাওয়াট, কুমিল্লায় সামিটের ২৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রের সাত মেগাওয়াট ও রূপগঞ্জের ৩৩ মেগাওয়াট কেন্দ্রের পাঁচ মেগাওয়াট, ঘোড়াশালে রিজেন্টের ১০৮ মেগাওয়াট কেন্দ্রের ২২ মেগাওয়াট, আশুগঞ্জে মিডল্যান্ডের ৫১ মেগাওয়াট কেন্দ্রের ছয় মেগাওয়াট এবং ইউনাইটেডের ময়মনসিংহের ২০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রের ৪২ মেগাওয়াট ও জামালপুরের ১১৫ মেগাওয়াটের মধ্যে ১২ মেগাওয়াট।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র একবার বন্ধ হয়ে গেলে তা আবার চালু করতে দু-তিন ঘণ্টা লাগে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত লাগতে পারে। এক্ষেত্রে দ্রুত চালু করা যায় ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। কিন্তু বেসরকারি খাতের রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গ্রিড বিপর্যয়ের দুই ঘণ্টার মধ্যে চালু করা যায়নি।

এমনকি ডিজেলচালিত চারটি কুইক আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) কেন্দ্রও গ্রিড বিপর্যয়ের দুই ঘণ্টার মধ্যে চালু হয়নি। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ৭০০ মেগাওয়াট। অথচ এ কেন্দ্রগুলোর জন্য উচ্চ হারে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় পিডিবিকে। সন্ধ্যা ৬টার পর ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সীমিত আকারে চালু করা হয়। পরে কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কিছুটা বাড়ানো হয়।

পরের এক ঘণ্টায় (৩টা থেকে ৪টা) আরও সাতটি কেন্দ্র সীমিত আকারে চালু হলেও একটি কেন্দ্র আবার বন্ধ হয়ে যায়। এতে বিপর্যয়ের তিন ঘণ্টা পর পূর্বাঞ্চল গ্রিডের ১৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে ছিল। পাশাপাশি প্রথম ধাপে চালু করা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পায়। এতে বিকাল ৪টায় পূর্বাঞ্চল গ্রিডে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ১৭৯ মেগাওয়াট।

এদিকে পূর্বাঞ্চল গ্রিড বিপর্যয়ের ধাক্কায় পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হলেও তিন ঘণ্টার মধ্যে আবার সেগুলো চালু করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ভোলার গ্যাসচালিত নতুন বিদ্যুৎ লিমিটেডের একটি ও এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনালের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সিরাজগঞ্জের গ্যাসচালিত ইউনিট-১ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত ঘোড়াশাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিটের যান্ত্রিক ত্রুটি থেকে মঙ্গলবার বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের সূত্রপাত হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুটি সাব-স্টেশনের মাঝখানে যে ইন্টারকানেকশন (আন্তঃসংযোগ) রয়েছে, তা হঠাৎ কারিগরি ত্রুটির কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এতে চাপ পড়ে ঘোড়াশাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যবস্থায়। আর ওই কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে তার প্রভাব পড়ে অন্যান্য সরবরাহ লাইনে। এতে বিদ্যুৎ সরবরাহ ফ্রিকোয়েন্সি আকস্মিক হ্রাস পায়। সে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেননি প্রকৌশলীরা। ফলে বিদ্যুৎ বিপর্যয় রূপ নেয় গ্রিড বিপর্যয়ে।

বিপর্যয়ের তিন ঘণ্টা পর অর্থাৎ বিকাল ৫টায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৫৫৭ মেগাওয়াট। ওই সময় পূর্বাঞ্চল গ্রিডে ১৯টি কেন্দ্র উৎপাদনে ছিল। পরের এক ঘণ্টায় উৎপাদনে আসা কেন্দ্রের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩-এ। এর সঙ্গে (১৬৬ মেগাওয়াট) আমদানি যুক্ত হয়ে সন্ধ্যা ৬টায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ৭৭২ মেগাওয়াট।

সন্ধ্যা ৭টায় বিদ্যুৎ উৎপাদন আরও বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৮০৫ মেগাওয়াট। ওই সময় উৎপাদনে আসে পূর্বাঞ্চল গ্রিডের ৪৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। রাত ৮টায় বিদ্যুৎ উৎপাদন আরও বেড়ে দাঁড়ায় সাত হাজার ১৯৪ মেগাওয়াট। ওই সময় উৎপাদনে ছিল ৬৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। রাত ৯টায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে ছিল ৬৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। ওই সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজার ৪৩১ মেগাওয়াট।

পর্যায়ক্রমে এভাবেই বন্ধ হয়ে যাওয়া বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র আবার চালু করা হয়। তবে চালু হওয়ার পর কারিগরি জটিলতায় আবার কয়েকটি কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। রাত ১০টায় ৭৩টি ও ১১টায় ৭৭টি বিদ্যুৎ উৎপাদনে আসে। এতে রাত ১০টায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩৩৪ মেগাওয়াট ও ১১টায় ৯ হাজার ৯৯৫ মেগাওয়াট। আর রাত ১২টায় মোট ৮০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসে। এতে ওই সময় বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট।