ঘাটাইলে বনের ভেতর শতাধিক অবৈধ করাতকল

শাহরিয়ার সিফাত, টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলায় বনের ভেতরে লাইসেন্স ছাড়াই ১২০টি করাতকল গড়ে উঠেছে। এছাড়া বনের আশপাশের দেড় কিলোমিটারের মধ্যে গড়ে উঠেছে আরও ৬০ করাতকল। এসব অবৈধ করাতকলে বৈধ গাছ ছাড়াও প্রতিদিন বনের গাছ চেরাই করে কাঠ পাচার করায় বনাঞ্চল ছাড়াও সংরক্ষিত বন দিন দিন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এতে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ঘাটাইল উপজেলার ধলাপাড়া রেঞ্জের আওতাধীন ৮৮.৪৫ বর্গকিলোমিটার বনাঞ্চলের বটতলী, ঝড়কা, চৌড়াসা, দেওপাড়া, ধলাপাড়া ও সাগরদিঘিÑএ ছয়টি বিটের ৪৯টি মৌজায় বনভূমি ও সংরক্ষিত বনভূমির পরিমাণ ২৯ হাজার ১০৬ দশমিক ৭৬ একর। এই বিশাল বনভূমিতে রয়েছে আকাশমণি, মেনজিয়াম, ইউক্যালিপ্টাস, সেগুন ও শাল-গজারি বনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছগাছালি। শালবনের ভেতরে ডিজেল মেশিন দিয়ে স্থাপন করা হয়েছে ১২০টি করাতকল। এসব করাতকল ও অতিরিক্ত গাছ চুরির কারণে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বাগান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। করাতকলের বিরুদ্ধে অভিযান না থাকায় সংরক্ষিত বাগান বিরান ভূমিতে পরিণত হচ্ছে।

জানা গেছে, বন বিভাগের নিয়মানুযায়ী বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে করাতকল স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারপরও রেঞ্জ অফিস ও বিট অফিসের নাকের ডগায় করাতকল স্থাপন করে দিনরাত চোরাকাঠ চিরাই করছে। সংশ্লিষ্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা, বিট কর্মকর্তা ও ফরেস্ট গার্ডদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এসব করাতকল চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৮০ করাতকলের প্রায় অর্ধেকই গত দুই বছরে স্থাপন করা হয়েছে। বনাঞ্চলসহ পরিবেশ রক্ষার্থে উপজেলায় বন ও পরিবেশ কমিটি থাকলেও এ কমিটির কার্যক্রম চলছে শুধু কাগজে-কলমে।

বনের ভেতরে কুশারিয়া, মাকড়াই, দেওজানা, নলমা, গাঞ্জানা, ছনখোলা, চাপড়ি, মুন্সীগঞ্জ, মানিকপুর, বোয়ালীহাটবাড়ী, ধলাপাড়া, পেঁচারআটা, শহরগোপিনপুর, সাগরদিঘি, জোড়দিঘি, মুরাইদ, আবেদ আলী, লক্ষ্মীন্দর, সিংহেরচালা, গারোবাজার, দেওপাড়া, শিবেরপাড়া, মালেঙ্গা, মমিনপুর, বগা, ফকিরচালাসহ বিভিন্ন স্থানে ডিজেল মেশিন দিয়ে গড়ে উঠেছে ১২০টি করাতকল।

একই সঙ্গে বনঘেঁষে আমতলা, দেউলাবাড়ী, পাকুটিয়া, পোড়াবাড়ী, কাইতকাই, ঝড়কা, বানিয়াপাড়া, মাইধারচালা ও দেলুটিয়ায় লাইসেন্স ছাড়া কর্মকর্তাদের মৌখিক অনুমতিতে চলছে আরও ৬০টি করাতকল। এছাড়া রসুলপুর ইউনিয়নে মুরাইদ দক্ষিণপাড়া বনের ভেতরে গড়ে উঠেছে কয়লা উৎপাদনের মিল। প্রতিদিন বনের গাছ কেটে এসব কয়লা উৎপাদন করা হচ্ছে। যত্রতত্র করাতকল স্থাপন অব্যাহত থাকায় বনাঞ্চল ছাড়াও সংরক্ষিত বন হুমকির মুখে পড়েছে।

এলাকাবাসী জানায়, বনের ভেতরে এসব করাতকলের ৯০ ভাগের মালিক কাঠ ব্যবসায়ীরা। কাঠ চোরদের সঙ্গে করাতকল মালিকদের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। যারা গাছ চুরির সঙ্গে জড়িত তারাও অনেকে করাতকল স্থাপন করে অবাধে বনের গাছ নিধন করছে।

অবৈধ করাতকল কীভাবে চলেÑজানতে চাইলে দেউলাবাড়ী ইউনিয়ন করাতকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক জানান, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিলেমিশেই করাতকল চালাতে হয়।

এসব অবৈধ করাতকলের বিষয়ে পৌর করাতকল মালিক সমিতির সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আ. হালিম জানান, উপজেলায় লাইসেন্সবিহীন দুই শতাধিক করাতকল চলছে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে বারবার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলার পর ২০১৭ সালের ২ আগস্ট অভিযান চালানো হয়। অভিযোগ আছে, অভিযান চালানোর কয়েকদিন পরই কর্তৃপক্ষ টাকার বিনিময়ে জব্দ করা করাতকল মালিকদের ফেরত দিয়ে দেয়।

বটতলী বিট কর্মকর্তা সোলায়মান হোসেন জানান, এসব করাতকল কীভাবে স্থাপন করা হয় তা তিনি জানেন না, তবে কোনো টাকা-পয়সা নেন না তিনি। ঘাটাইলের ধলাপাড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানান, এসব করাতকল কীভাবে চলে তিনি জানেন না। তবে করাতকল স্থাপনের সঙ্গে তিনি কিংবা তার বিট অফিসারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

করাতকল বন্ধ করার বিষয়ে ঘাটাইল উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা বন ও পরিবেশ কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম খান জানান, উপজেলা মাসিক সভায় অবৈধ করাতকল বন্ধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনেকবার বলা হয়েছে, কিন্তু উপজেলা প্রশাসন থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কাশেম মোহাম্মদ শাহীন জানান, বনের বিষয়গুলো বন বিভাগের কর্মকর্তারা দেখভাল করেন। ২০১৭ সালের আগস্টে পাঁচটি নয় ১৬-১৭টি করাতকল জব্দ করা হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সে সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। জব্দ করাতকলগুলোর বিষয়ে বন বিভাগ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এ বিষয়ে মামলা চলমান রয়েছে এবং করাতকলগুলো জব্দ তালিকা অনুযায়ী সংরক্ষণ করা আছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০