নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারের দেবীদাস লেন এলাকায় প্লাস্টিক কারখানা ও গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ছয়জনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। নিহত ছয়জন ‘বরিশাল হোটেলের’ কর্মচারী ছিলেন। তারা রেস্তোরাঁর ওপরের পাটাতনে ঘুমিয়ে ছিলেন। অগ্নিকাণ্ডের পর তারা আর বের হতে পারেননি, সেখানেই পুড়ে মারা যান। গতকাল সোমবার দুপুর ১২টায় চকবাজারের কামালবাগের দেবীদাস লেন এলাকার ওই চারতলা ভবনে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট সোয়া দুই ঘণ্টার চেষ্টায় তা নিয়ন্ত্রণে আনে। ভবনটির নিচতলাতেই ‘বরিশাল হোটেল’ নামে একটি রেস্তোরাঁ রয়েছে।
রেস্তোরাঁয় দুই শিফটে শ্রমিকরা কাজ করতেন। যারা রাতে কাজ করেছেন, তারা রেস্তোরাঁর দোতলায় দিনে ঘুমাচ্ছিলেন। অগ্নিকাণ্ডের সময় তারা আর বের হতে পারেননি। নিহত ছয়জনই রেস্তোরাঁর শ্রমিক। তবে নিহতদের শরীর পুড়ে যাওয়ায় তাদের পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ।
এদিকে রাজধানীর চকবাজারের দেবীদাস লেন এলাকায় প্লাস্টিক কারখানা ও গোডাউনে লাগা আগুনে দগ্ধ হয়ে নিহত ছয়জনের পরিচয় মিলেছে। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতাল মর্গে চারজনের পরিচয় ভাই ও দুজনের পরিচয় মামা শনাক্ত করেন।
তারা হলেন হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার রাকেশ সরকারের ছেলে স্বপন সরকার (১৯), শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার দক্ষিণ বড় কাসমা এলাকার আবুল কালাম সরদারের ছেলে ওসমান (২৫), বরিশালের মুলাদী উপজেলার টুমচর এলাকার মৃত আলম সরদারের ছেলে বিল্লাল (৩৫), একই বিভাগের হিজলা উপজেলার শংকরপাশা এলাকার মো. মোস্তফার ছেলে মোতালেব (১৬), কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার তিতচর এলাকার মিজানের ছেলে মো. শরীফ (১৬) ও মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার দক্ষিণ আকাল বরিশ এলাকার সাত্তার হিলালুর ছেলে রুবেল (২৮)।
তবে আরও কয়েকজনের নিখোঁজ থাকার কথা শোনা যায়। আব্দুল্লাহ নামে একজন জানান, তার ভগ্নিপতি বিল্লাহকে (৩৩) খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমার বোনের স্বামীর নাম বিল্লাহ, তিনি হোটেলের কর্মচারী। তিনি নাইট ডিউটি করে দিনে ঘুমাচ্ছিলেন। আগুন লাগার পর থেকে তার আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
রেস্তোরাঁটিতে যেসব শ্রমিক কাজ করতেন, তাদের স্বজনরা ঘটনার পর থেকেই ভবনের সামনে ভিড় করেন। মো. রুবেল নামে এক যুবক অভিযোগ করেন, তার খালাতো ভাই ওসমানকে (২৫) খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, ‘আমার খালাতো ভাই বরিশাল হোটেলে চাকরি করত। রাতে কাজ করে সে ভবনটির দোতলার মতো করে তৈরি করা পাটাতনে ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু আগুন লাগার পরে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা আগুন লাগা ভবনটির দোতলায় গিয়েছিলাম। সেখানে আমরা মানুষের হাড়ের মতো কিছু দেখতে পেয়েছি।
ভবনটিতে পলিথিন ও প্লাস্টিকের কারখানা ছিল। কারখানার মালিক নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। ঘটনার পর থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। হোটেল মালিক ফখর উদ্দিনকেও ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি, তবে তাদের লোকজন ভবনের সামনে ঘোরাফেরা করেছেন। তারা কোনো কথা বলতে রাজি হননি। ভবনের মালিক মো. আলম নামে এক ব্যক্তি। তার ছেলে রানা ভবনটি দেখাশোনা করেন। ঘটনার পর তারাও গা ঢাকা দিয়েছেন।
ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ছয়জনের মরদেহ পাওয়া গেছে। তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি বলেন, সোমবার দুপুর ১২টায় আগুন লাগার পর প্রায় আড়াই ঘণ্টা চেষ্টা করে আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণ করেছি। এখন তল্লাশি চলছে। তল্লাশি শেষে আমরা নিশ্চিত করতে পারব কতজন মারা গেছেন।
তিনি বলেন, পুরান ঢাকার চকবাজারের দেবীদাস লেনে আগুন লাগা পলিথিনের কারখানাসহ আশপাশের এলাকার বহু ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। কর্নেল জিল্ল–র রহমান বলেন, ‘চকবাজারে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে এসে দেখি আশপাশের বহু ভবনে যত্রতত্র গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের কারখানা, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একদিকে ঘিঞ্জি এলাকা, অন্যদিকে এসব কারখানায় যখন-তখন যেকোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। পাশাপাশি অনেক ভবনে মানুষ বাসও করছেন। তাদের জন্যই ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।’
আগুনের সূত্রপাতের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা বলেন, আগুনের সূত্রপাতের নির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। আমরা আগুন নির্বাপণ শেষে তদন্ত কমিটি গঠন করব। তারপর জানতে পারব আসলে কীভাবে আগুন লেগেছে।
তবে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, পাশের ভবনটিতে আগুনের সূত্রপাত হয় এবং সেখান থেকে চারতলা ভবনের নিচতলায় থাকা হোটেলে আগুন লাগে। সেখান থেকে প্রচুর বাতাসে ভবনের চারতলায় প্লাস্টিক কারখানায় ও গোডাউন যে তলায়, সেখানে আগুন লেগে যায়।