মো. মঈনউদ্দীন: কথাগুলো বলতে বলতে বারবার চোখ মুছছিলেন স্মৃতি বিশ্বাস। তার জীবনসংগ্রামের কাহিনি যেন সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। খুলনার রূপসা উপজেলার ডোবা গ্রামে এক হতদরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। দিনমজুর বাবা কৃষ্ণপদ রায় আর গৃহিণী মা সলকা রায়ের ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে স্মৃতি বিশ্বাস ছিলেন সবার বড় মেয়ে। টানাপড়েনের সংসার। তাই মাত্র ১৬ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের ছয় মাস পেরোতে না পেরোতেই স্মৃতি বিশ্বাসের ওপর নেমে আসে অবর্ণনীয় নির্যাতন। সংসারের সব কাজকর্ম সেরে সময়মতো রান্না করতে না পারলে স্বামী অমানবিকভাবে মারধর করতেন। দিন দিন নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এসবের পেছনে মূল কারণ ছিল যৌতুক। যৌতুক দিতে না পারার জন্য শেষ পর্যন্ত তাকে মেরে ফেলার চক্রান্ত করা হয়। একপর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্বামী তাকে বাবার বাড়ি রেখে ভারতে গিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করে দিশাহারা হয়ে পড়েন স্মৃতি। সন্তান জন্মের পর সেই চিন্তা আরও বেড়ে যায়। কী করবেন, কোথায় যাবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি।
চরম অনিশ্চয়তা আর দুশ্চিন্তার মধ্যে স্মৃতি বিশ্বাস সন্ধান পান উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ে। একদিন মহিলা উপজেলাবিষয়ক কর্মকর্তা তাহিরা খাতুনের সঙ্গে দেখা করে তার জীবনের করুণ কাহিনি বর্ণনা করেন। সব শুনে তাহিরা খাতুন পরম মমতায় স্মৃতির কাঁধে হাত রাখলেন; বললেন, তোমার মতো অসহায় আর নিপীড়িত নারীর পাশে আছে সরকার। নির্যাতনের শিকার নারীদের আইনগত পরামর্শ ও সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়সহ জেলা ও উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ে আছে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি’। এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া বিভাগীয় পর্যায়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল এবং নির্যাতিত নারীদের সাময়িক অবস্থানের জন্য আবাসন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এসব সেলে নির্যাতনের শিকার নারীর অভিযোগ গ্রহণ এবং দেনমোহর, স্ত্রীর ভরণপোষণ, খোরপোষ ও সন্তানের ভরণপোষণ আদায় করা হয়।
তাহিরা খাতুন ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) বিষয়েও বললেন। সাতটি বিভাগীয় শহরে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই ওসিসি স্থাপন করা হয়েছে। এখান থেকে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের চিকিৎসা সহায়তা, আইনি সহায়তা, পুলিশি সহায়তা, ডিএনএ পরীক্ষা, মানসিক কাউন্সেলিং, আশ্রয় ও সমাজে পুনর্বাসনের জন্য সহযোগিতা প্রদান করা হয়। দুস্থ ও অসহায় এবং শারীরিকভাবে সক্ষম মহিলাদের উন্নয়ন স্থায়িত্বের জন্য দুই বছরব্যাপী প্রতি নারী প্রতি মাসে ৩০ কেজি খাদ্যশস্য ও প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে। এটি ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট (ভিজিডি) নামে পরিচিত, যা সরকারের সবচেয়ে বড় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। এখন পর্যন্ত ভিজিডির উপকারভোগীর সংখ্যা সাড়ে সাত লাখের অধিক। শুধু তাই নয়, দরিদ্র মা ও শিশুর মৃত্যুহার হ্রাস, মাতৃদুগ্ধ পানের হার বৃদ্ধি, গর্ভাবস্থায় উন্নত পুষ্টি উপাদান গ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাতৃত্বকালীন ভাতা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কোনো মা প্রতি মাসে ৮০০ টাকা হারে তিন বছরব্যাপী এ ভাতা পান। প্রায় এক লাখ ২০ হাজার মা এখন পর্যন্ত এ ভাতা পেয়েছেন।
সরকারের এত সব সহায়তার কথা শুনে স্মৃতি বলে ওঠেন, আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই, আর কারও কাঁধে বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। আমাদের সরকারও চায় নারী, বিশেষত তৃণমূল নারী আত্মনির্ভরশীল হোক। আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডের মূল ধারায় পুরুষের মতো সমানভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতায়ন ও দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করুক। এজন্য গ্রামীণ দুস্থ মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে জেলা ও উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। এসব কেন্দ্রে কম্পিউটার, টেইলারিং, ব্লক ও বাটিক, বিউটি ফিকেশন, মোবাইল ফোন সার্ভিসিং, হাউস কিপিংসহ নানা বিষয়ে বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিভিন্ন মেয়াদে পরিচালিত এসব প্রশিক্ষণ চলাকালে প্রশিক্ষণ ভাতাও পাওয়া যায়। আবার এসব বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ শেষে বিত্তহীন ও দরিদ্র মহিলারা যেন উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হতে পারে, সেজন্য সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের ব্যবস্থাও আছে। একইসঙ্গে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব নারী উদ্যোক্তা এবং ক্ষুদ্র সংগঠনের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা যেন সহজে বিপণন ও বাজারজাত করা যায়, সেজন্য জয়িতা ও অঙ্গনা নামে দুটি প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কাছে সব শুনে স্মৃতি বিশ্বাস যেন সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আলোর রেখা দেখতে পান।
স্মৃতি স্বাবলম্বী হতে তিন মাসব্যাপী টেইলারিং কোর্সে ভর্তি হন। ছোট বাচ্চাকে সামলে প্রশিক্ষণ নিতে বেশ কষ্ট হলেও হাল ছাড়েননি স্মৃতি। সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষে মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিলেন। তা থেকে কিছু টাকা দিয়ে একটি সেলাই মেশিন আর কিছু টাকা দিয়ে মুদি মালামাল কিনে রাস্তার পাশে ছোট ঘর উঠিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। এরপর আর স্মৃতির পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তিনি দুটি দোকান ও পাঁচটি সেলাই মেশিনের মালিক। নিজে সেলাইয়ের পাশাপাশি এলাকার মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেন। এখন তার মাসিক আয় ২০ হাজার টাকা। একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে এলাকার সবার কাছে তিনি পরিচিত। তিনি সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। সে এখন সেনাবাহিনীতে চাকরি করে।
অত্যাচার-নির্যাতন অতিক্রম করে আত্মবিশ্বাস, অক্লান্ত পরিশ্রম আর সরকারের সহযোগিতার ফলে স্মৃতি বর্তমানে একজন সুখী ও স্বাবলম্বী নারী। তার এ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জেলা প্রশাসন ও মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয় তাকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় ‘নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছে যে নারী’ ক্যাটেগরিতে খুলনা জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হিসেবে সম্মাননা প্রদান করেছে। স্মৃতির মতো নারীদের এগিয়ে নিতে সরকার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, যার মূল প্রতিপাদ্য ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের সহায়তা ও প্রচেষ্টায় পিছিয়ে পড়া নারীরা ঘুরে দাঁড়াতে পারছে এবং ঘুরে দাঁড়াবে। দেশ হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা সব স্বাবলম্বী নারীকে নিয়ে সবার সঙ্গে।
স্মৃতির ঘুরে দাঁড়ানোর আনন্দের কান্না উজ্জীবিত করুক দেশের সব পিছিয়ে পড়া নির্যাতিত নারীকে তাদের সাহস জোগাক জীবনযুদ্ধ জয়ের। বিজয় সুনিশ্চিত স্মৃতির মতোই।
পিআইডি নিবন্ধ