ঘুরে দাঁড়ানোর কঠিন লড়াইয়ে বানভাসি

শেয়ার বিজ ডেস্ক: ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১১ জেলায় আকস্মিক বন্যায় বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। অনেকেরই ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। সহায়সম্বল হারিয়ে অসহায় তুলনামূলক সচ্ছলরাও। বন্যার পানি নামতে শুরু করায় জেগে উঠছে ক্ষত। বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন অনেকে। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি তারা। বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যেমন নাস্তানুবাদ, আরেকদিকে পর্যপ্ত খাদ্য ও সুপেয়ে পানি সংকটে ভুগছেন তারা। পাশাপাশি পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বানভাসিরা। কিন্তু চিকিৎসকের অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে না তাদের।
এদিকে বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫২ জনে দাঁড়িয়েছে। মৃতের এ সংখ্যা গত বুধবার ছিল ৩১ জন। গতকাল দুপুর ১টা পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বন্যায় কুমিল্লায় ১৪ জন, ফেনীতে ১৭, চট্টগ্রামে ছয়, খাগড়াছড়িতে এক, নোয়াখালীতে আট, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক, লক্ষ্মীপুরে এক ও কক্সবাজার তিনজন মারা গেছেন। এছাড়া মৌলভীবাজারে একজন নিখোঁজ রয়েছেন। বন্যায় ১০ লাখ ৭২ হাজার ৫৭৯ পরিবার পানিবন্দি হয়েছেন। পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় দেয়ার জন্য মোট তিন হাজার ৪০৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট ৫ লাখ ২ হাজার ৫০১ জন মানুষ এবং ৩৬ হাজার ৪৪৮টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য মোট ৫৯৫টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে। এছাড়া দেশের সব জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুত রয়েছে বলে জানিয়েছে ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত কমে আসায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত আছে; সেই সঙ্গে দুর্গত এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কেরও উন্নতি হচ্ছে।

আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান খান বৃহস্পতিবার বিকালে বলেন, ‘আগামী কয়েকদিনে সামান্য বৃষ্টিপাত হতে পারে দেশের অধিকাংশ জায়গায়। ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বৃষ্টি অনেকটাই কমে এসেছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।’ বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বৃহস্পতিবারের বুলেটিনে জানিয়েছে, দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার থেকে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। ফলে এ সময় মনু, খোয়াই, ফেনী, মুহুরী, গোমতী, তিতাস নদীর পানি সমতল হ্রাস পেতে পারে।
সেই সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সাঙ্গু, হালদা, মাতামুহুরী, কর্ণফুলী, উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র, যমুনাসহ প্রধান নদ-নদীর পানি কমতে পারে বলে বুলেটিনে বলা হয়েছে।
গেল ২৪ ঘণ্টায় নোয়াখালীর মাইজদীকোর্টে দেশের সর্বোচ্চ ৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত নথিবদ্ধ করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এই সময়ে বান্দরবানে ২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত ছাড়া দেশের আর কোথাও উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়নি।

আব্দুর রহমান বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে মাঝখানে বা মধ্য বঙ্গোপসাগরে এখনও একটি লঘুচাপ রয়েছে। তবে এর প্রভাব পড়বে না দেশে। এটি আরও শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
এদিকে রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) প্রতিনিধি জানান, লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে উপকূলীয় মেঘনার চরাঞ্চল এলাকা থেকে নামতে শুরু করেছে বন্যার পানি। বেরিয়ে আসছে বন্যার ক্ষতচিহ্ন। সঙ্গে দেখা দিচ্ছে নানা রোগব্যাধি। ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ জ্বর, সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হচ্ছে বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ। অনেকের হাতে-পায়ে ঘা, খোসপাঁচড়া দেখা দিয়েছে। গত ১২ দিন ধরে বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করায় রায়পুরে বয়স্ক ও শিশুরা জ্বর, সর্দি-কাশি ও ডায়রিয়ায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্তরা বলছেন, চারদিক এখনও পানিতে তলিয়ে আছে। ডাক্তার এবং পর্যাপ্ত ওষুধপত্র ও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।

রায়পুর উপজেলায় প্রায় চার লাখ মানুষের বসবাস। ১৯৭২ সালে রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির কার্যক্রম শুরু হলেও ডাক্তারদের ৩১টি পদের মধ্যে আছেন ১৭ জন। এর মধ্যে চারজন ছুটিতে আছেন। বাকি সাতজন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, ছয় চিকিৎসক আছেন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। দুই চিকিৎসক ছুটি না নিয়ে গত ১২ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। এই সংকটের মধ্যেও পাঁচজন চিকিৎসককে সাবেক এমপি ও সিভিল সার্জনের সুপারিশে সদর হাসপাতালে ডেপুটেশনে রাখা হয়েছে। কিন্তু তারা বেতন তুলছেন রায়পুর থেকে। এতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক-নার্সের সংকটে চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হচ্ছেন প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী।

সূত্রে জানা যায়, গত ১২ দিনের ভারী বর্ষণ ও জোয়ারের কারণে সৃষ্ট বন্যায় গত বুধবার পর্যন্ত ১০ জন সাপেকাটা রোগী এবং প্রায় শতাধিক ডায়রিয়া, ঠান্ডা-শ্বাসকষ্টের রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। পাশাপাশি বন্যায় ৩৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষকে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইমরান খান বলেন, ‘পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় ৩৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষকে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে।’

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. বাহারুল আলম বলেন, ‘প্রতিদিন জরুরি বিভাগে ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এখানে চিকিৎসক থাকার কথা ৩১ জন, আছেন ১৭ জন। এর মধ্যে চারজন ছুটিতে। সিভিল সার্জনের সুপারিশে পাঁচ জন ডাক্তার সদর হাসপাতালে ডেপুটেশনে আছেন। স্বাস্থ্যকর্মীরা নৌকায় করে দুর্গম এলাকায় বানভাসিদের খোঁজখবর নিচ্ছেন এবং প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দিচ্ছেন।’

লক্ষ্মীপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. আহাম্মদ কবীর জানিয়েছেন, বানভাসিদের চিকিৎসা দিতে ৬৩টি ও একটি বিশেষ মেডিকেল টিম কাজ করছে। ইউনিয়ন পর্যায়ের ৪০টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও তিনটি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র পানিতে ডুবে গেছে। আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিভিন্ন স্থানে বন্যার্তদের চিকিৎসা দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তারা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০