ঘুষ নিয়ে নার্স বদলি, সরকারি কর্মকর্তারাও ভাগ পেয়েছেন

নজরুল ইসলাম:‘মাইক্রোসফট হেলথ প্রডাক্ট লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে রিপ্রেজেন্টিটিভ হিসেবে চাকরি করতেন জামাল উদ্দিন। যাতায়াত ছিল নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে। সেই সুযোগে সেখানকার কর্মচারীদের সঙ্গে গড়ে ওঠে সখ্য। ঝোপ বুঝে কোপ মেরে তিনি গড়ে তোলেন বদলি বাণিজ্যের সিন্ডিকেট। শুরু করেন দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নার্স বদলি। নার্সদের কাছ থেকে ঘুষ হিসেবে হাতিয়ে নেন সাত কোটি ২৩ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। ঘুষ বিনিময়ের এমন প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে দুদক।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, এ ঘটনায় জামাল উদ্দিন ও তার স্ত্রী শাকিরন নেছার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের অনুমোদন দিয়েছে কমিশন। ঘুষের এসব টাকা থেকে সরকারি কর্মকর্তারাও ভাগ পেয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে সেটি উপস্থাপন করা হবে। এছাড়া নার্সরা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন, নাকি যোগসাজশ রয়েছে, সে বিষয়টিও তদন্ত করে দেখা হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘুষ গ্রহণে পাঁচটি ব্যাংকের ১৪টি হিসাব নম্বর ব্যবহার করা হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় কর্মরত সরকারি হাসপাতালের নার্সদের কাছ থেকে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা ঘুষ হিসাবে গ্রহণ করে পছন্দের কর্মস্থলে তাদের বদলি করা হতো।

দুদক বলছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত জামাল উদ্দিনের ওইসব হিসাবে মোট সাত কোটি ২৩ লাখ ৫৪ হাজার টাকা জমা হয়েছে। এর মধ্যে ছয় কোটি ৯২ লাখ ২২ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। হিসাবগুলোয় জামাল উদ্দিনের বেতন বা ব্যবসায়ের কোনো আয় জমা হয়নি। ২০২১-২০২২ আয়কর বর্ষে তিনি স্টক ব্যবসা করে ১২ লাখ টাকা আয় এবং পাঁচ লাখ ৪৪ হাজার ৭০০ টাকা ব্যয় করেছেন। আয়কর নথি অনুযায়ী, তার তিন কোটি ১৬ লাখ ৯৭ হাজার ৩৩ টাকার সম্পদ পাওয়া গেছে। ২০২১-২২ আয়কর বর্ষে তার স্ত্রী শাকিরন নেছা স্টক ব্যবসা করে সাত লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা আয় এবং এক লাখ ২০ হাজার টাকা ব্যয় করেছেন। আয়কর নথি অনুযায়ী, তার ৫৬ লাখ ৮৫ হাজার ৩০৫ টাকার সম্পদ পাওয়া গেছে। কিন্তু অনুসন্ধানকালে তাদের নামে স্টক ব্যবসার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে ২০২২ সালের ৯ জুন মেসার্স নিউ জামাল এন্টারপ্রাইজ (মালিক শাকিরন নেছ) নামে রড ও সিমেন্টের ব্যবসার জন্য লাইসেন্স নেয়া হয়। তারা নার্স বদলি করে ঘুষ নেয়া টাকা দিয়ে রড ও সিমেন্টের ব্যবসা শুরু করেন।

এর আগে ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চে দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। সেখানে বলা হয়, মোট পাঁচ ব্যাংকের ১৪টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে এ টাকা ঘুষ হিসাবে গ্রহণ করা হতো। বেআইনিভাবে গ্রহণ করা এ টাকা উৎকোচ হিসেবে পাওয়ার পরই নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের এক বা একাধিক কর্মকর্তার সহায়তায় জামাল উদ্দিন নার্সদের পছন্দের কর্মস্থলে বদলি করতেন।

প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর নার্সিং ও মিডওয়াফারি অধিদপ্তরের কোন কোন কর্মকর্তা ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে এ নার্স বদলিতে জড়িত, তাদের তালিকাসহ পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ২০ জানুয়ারি মধ্যে আদালতে দাখিল করতে দুদককে নির্দেশ দেয়া হয়।

নার্স বদলিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন ল’ অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশনের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব, মোহাম্মদ কাওছার ও মাজেদুল কাদের। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ১৮ মে হাইকোর্ট এ বিষয়ে দুদককে তদন্তের নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশনা পেয়ে দুদক এ বিষয়ে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেন উপপরিচালক মো. ফারুক আহমেদকে।

প্রসঙ্গত, জামাল উদ্দিনের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। থাকেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে।

নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, মহাপরিচালক (ডিজি) পদে ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ১২ মার্চ পর্যন্ত অতিরিক্ত সচিব ডা. কাজী মোস্তফা সারোয়ার, ২০১৭ সালের ১৩ মার্চ থেকে ২০১৯ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত অতিরিক্ত সচিব তন্দ্রা শিকদার, ২০১৯ সালের ২৯ জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ শাহাদত হোসেন, ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অতিরিক্ত সচিব আলম আরা বেগম, ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অতিরিক্ত সচিব সিদ্দিকা আক্তার এবং ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অতিরিক্ত সচিব রাশেদা আক্তার কর্মরত ছিলেন। তার পর থেকে ডিজির পদ শূন্য রয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০