রিয়াদ হোসেন: প্রতি বছর আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় ও ঝড়বৃষ্টি থেকে সুন্দরবন বুক চিতিয়ে রক্ষা করে আসছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে। মাতৃস্নেহে আগলে রাখা সুন্দরবনের কারণে উপকূলীয় জনপদে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম হয়। কিন্তু এবার ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। ক্ষতির আশঙ্কায় হাজার হাজার বন্যপ্রাণী। অন্যবারের তুলনায় এ বছর ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে নদীতে জোয়ারের পানি অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ৫ থেকে ৭ ফুট উঁচু জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে গোটা সুন্দরবন। সুন্দরবনে নোনাপানি প্রবেশ করায় সুন্দরবনের ভেতরে থাকা মিষ্টিপানির আধারগুলোও তলিয়ে গেছে। যেখান থেকে বন্যপ্রাণী, জেলে ও মৌয়ালরা পানি পান করত। বিগত বছরগুলোয় আঘাত হানা আয়লা, সিডরের চেয়েও এ বছরের ঘূর্ণিঝড়ে নদীর পানি বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পানির চাপটাও এবার বেশি ছিল পুরো উপকূলজুড়ে। সুন্দরবনের দুবলার চর, কটকা, কচিখালী, শ্যালাবুনিয়া, আলোরকোল, কুকিলমুনিসহ বিভিন্ন এলাকা ডুবে গেছে। এতে সুন্দরবনে বসবাসরত অনেক বন্যপ্রাণী ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে অন্যান্য প্রজাতির বন্যপ্রাণী এই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলেও হরিণশাবকগুলোর অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে জোয়ারের পানিতে উপকূলীয় খুলনার কয়রা উপজেলার হড্ডা গ্রামে একটি হরিণ শাবক ভেসে আসতে দেখা গেছে। পরে সেটি উদ্ধার করে আবারও বনে ছেড়ে দিয়েছে বনরক্ষীরা।
বিশেষ করে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী প্রজনন ও ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রগুলো পর্যটকদের সুবিধার জন্য একটু উঁচু করে তৈরা করা। সেগুলোও এবার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। তুলনামূলকভাবে এখানকার প্রাণীরা নিরাপদে থাকলেও বনের গহিনে যেসব প্রাণীর বসবাস তাদের অবস্থা হয়তো এবার আশঙ্কাজনক। যদিও ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে সুন্দরবনের ভেতরে বন্যপ্রাণীর আশ্রয়ের জন্য বনের ভেতরের বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি উঁচু টিলা তৈরি করে রাখা হয়েছে। পানি বাড়লে প্রাণীরা সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে থাকে। তবে এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ব্যতিক্রম। দীর্ঘক্ষণ বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাস হওয়ার কারণে পানির উচ্চতা অন্যবারের তুলনায় বেশি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, অনেক উঁচু টিলাও রেমালের প্রভাবে পানিতে নিমজ্জিত হয়ে ছিল। এতে প্রাণীগুলোর জীবন হুমকির মধ্যে রয়েছে।
একটানা ২০ ঘণ্টা ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডব ও জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতিতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা হয়তো এ মুহূর্তে জানা যাবে না। জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে ইতোমধ্যে অনেক পত্রপত্রিকায় মৃত হরিণ ভেসে আসারও খবর মিলছে, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। এদিকে মিষ্টিপানির আধারগুলোতে নোনাপানি উঠায় আগামীতে বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রাণীরাও সুপেয় পানির সংকটে পড়বে। ফলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ঘূর্ণিঝড় রেমালের দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রভাব পড়বে সুন্দরবনসহ উপকূলীয় জনপদে। বিশেষ করে এবার সুন্দরবনের ভেতরে নানা সংকট দেখা দেবে। এজন্য পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়কে সুন্দরবন রক্ষায় আরও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বন কর্তৃপক্ষকে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আরও বেশি আন্তরিক হতে হবে। বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের চাঁদপাই, শরণখোলা, খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের প্রতিটিতে ৩টি করে মোট ১২টি বাঘের টিলা নির্মাণ করা হচ্ছে। যার কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। পাশাপাশি মিঠাপানির জলাশয়গুলোকে সংস্কার করতে হবে যাতে বন্যপ্রাণীরা সহজে পানি পান করতে পারে। আমরা আশা রাখি, সুন্দরবনকে টিকিয়ে রাখতে সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করবে; বন্যপ্রাণীদের রক্ষায় ইতোমধ্যে যেসব প্রকল্প পাস হয়েছে সেগুলো পরিকল্পিতভাবে এবং স্বচ্ছতার মধ্যে দিয়ে বাস্তবায়ন হবে।
শিক্ষার্থী, সরকারি বিএল কলেজ
খুলনা