ঘোষণার চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন লোডশেডিংয়ের হিসাবে গোঁজামিল!

ইসমাইল আলী: দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। যদিও সক্ষমতার প্রায় ৪০ শতাংশ বসেই থাকে। তবে গ্যাস-তেল সংকটের কারণে চলতি মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে কমিয়ে দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। শুরু হয়েছে লোডশেডিং। আর ১৯ জুলাই থেকে শুরু করা হয়েছে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং। তবে লোডশেডিংয়ে হিসাবে রয়েছে গোঁজামিল। ডিজেলচালিত কেন্দ্র বন্ধের কথা বলা হলেও উৎপাদন কমিয়ে দেয়া হয়েছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। ফলে বেড়ে গেছে লোডশেডিংয়ের হার।

গত ১৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত-সংশ্লিষ্টদের। এতে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং ছাড়াও সপ্তাহে এক দিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখাসহ একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি তেলের ব্যবহার ও লোকসান কমাতে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, ১৮ জুলাই পর্যন্ত ডিজেলচালিত সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু ছিল। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ছয়টি ও একটি সরকারি। বেসরকারি ছয়টি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার মেগাওয়াট। আর সরকারি কেন্দ্রটির সক্ষমতা ২২৫ মেগাওয়াট। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৯ জুলাই থেকে বন্ধ হওয়ার কথা এক হাজার ২২৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র। যদিও বাস্তব চিত্র ভিন্ন।

১৯ জুলাই থেকে ডিজেলচালিত এক হাজার ২২৫ মেগাওয়াট কেন্দ্র বন্ধের পাশাপাশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কয়েকটিতে উৎপাদন কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে প্রকৃতপক্ষে উৎপাদন অনেক কমে গেছে। ফলে বেড়েছে লোডশেডিংয়ের হার। এর প্রভাব পড়েছে সরকার ঘোষিত ঘণ্টাভিত্তিক লোডশেডিং সূচিতেও। রাজধানীর বাইরে কোথাও কোথাও ৪-৫ ঘণ্টা করেও লোডশেডিং হচ্ছে। পল্লী বিদ্যুৎতায়ন বোর্ডের (আরইবি) এলাকায় এ সমস্যা সবচেয়ে বেশি।

পিডিবির তথ্যমতে, ১৮ জুলাই দেশে বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। সেদিন উৎপাদন করা হয় ১৪ হাজার ৯১৯ মেগাওয়াট। ফলে উৎপাদন পর্যায়ে কোনো লোডশেডিং ছিল না। বরং সেদিন ৪১৯ মেগাওয়াট উদ্বৃত্ত ছিল। তবে সঞ্চালন ও বিতরণ পর্যায়ে সিস্টেম লসের কারণে গ্রাহক পর্যায়ে সেদিন কিছু এলাকায় সীমিত আকারে লোডশেডিং হয়।

পরের দিন (১৯ জুলাই) পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। সেদিন উৎপাদন করা হয় সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট। ফলে উৎপাদন পর্যায়েই ঘাটতি দেখা দেয় এক হাজার ৯১৮ মেগাওয়াট। তবে সিস্টেম লসের কারণে বিতরণ পর্যায়ে আড়াই হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হয়।

এদিকে ২০ জুলাই বিদ্যুৎ উৎপাদন আরও কমে যায়। এ দিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টি হওয়ায় চাহিদা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। তবে ওই দিন সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ১২ হাজার ৫১ মেগাওয়াট। ফলে উৎপাদন পর্যায়েই ঘাটতি দেখা দেয় দুই হাজার ১৪৯ মেগাওয়াট। বিতরণ পর্যায়ে লোডশেডিং হয় প্রায় দুই হাজার ৮০০ মেগাওয়াট।

সূত্র জানায়, সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন কমার কথা ছিল এক হাজার ২২৫ মেগাওয়াট। কিন্তু বাস্তবে তার চেয়েও বেশি উৎপাদন কমে গেছে। এর মূল কারণ গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়া। যেহেতু লোডশেডিংয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আছে তাই বিষয়টি অনেকেরই নজর এড়িয়ে গেছে। ফলে পিডিবি উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।

জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, বেশকিছু দিন ধরেই গ্যাস সরবরাহ ওঠানামা করছে। ঈদুল আজহার আগে পেট্রোবাংলা গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গিয়েছিল। সে সময় লোডশেডিং শুরু হয়। মাঝে গ্যাস সরবরাহ কিছুটা বাড়ানো হয়। তবে ১৯ জুলাই থেকে আবারও গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে। এতে বাধ্য হয়েই ডিজেলের পাশাপাশি গ্যাসচালিত কেন্দ্রেও উৎপাদন কমাতে হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৮ জুলাই বিদ্যুৎ উৎপাদনে পেট্রোবাংলা গ্যাস সরবরাহ করে এক হাজার ১১৬ দশমিক ৯০ এমএমসিএফ। পরের দুদিন তা অনেকখানি কমিয়ে দেয়া হয়। এর মধ্যে ১৯ জুলাই বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ ছিল ৯৮৩ দশমিক ২০ এমএমসিএফ। আর ২০ জুলাই তা আরও কমে দাঁড়ায় ৯৪৩ দশমিক ২০ এমএমসিএফ। ফলে বাধ্য হয়েই গ্যাসচালিত কেন্দ্রে উৎপাদন কমিয়েছে পিডিবি।

এদিকে গত ২০ জুলাই পিডিবির বিভিন্ন জোনে সরবরাহ করা বিদ্যুৎ পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, পিক আওয়ারে সাব-স্টেশন পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি ছিল ঢাকা বিভাগে। ওই দিন সন্ধ্যায় ঢাকায় ৭৮৩ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। সে সময় খুলনায় ৩৩০ ও রাজশাহীতে ৩০৩ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল সাব-স্টেশন পর্যায়ে। একই সময়ে কুমিল্লায় ২৫৩, চট্টগ্রামে ২৪৫, ময়মনসিংহে ২২০, রংপুরে ১৮০ ও সিলেটে ৯১ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল। তবে বরিশাল বিভাগে সাব-স্টেশন পর্যায়ে কোনো লোডশেডিং ছিল না।

যদিও ঘাটতি সমন্বয় করতে আপাতত দিনে এক ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি ১৮ জুলাই সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) থেকে শুরু করব। এক সপ্তাহ দেখব। যদি দেখি এক ঘণ্টায় হচ্ছে, ফাইন। এলাকাভিত্তিক আমরা সারা বাংলাদেশে যদি এক ঘণ্টা লোডশেডিং দিই, আমার মনে হয় না তেমন সমস্যা হবে।’

অথচ প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য ঠিক থাকেনি প্রথম দিন থেকেই। কোথাও কোথাও ৩-৪ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়েছে। কোথাও আরও বেশি। পরের দুই দিনও একই চিত্র দেখা গেছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০