আলমগীর হোসেন: পাইকারি বাজার হিসেবে খ্যাত পুরান ঢাকার চকবাজারে পণ্যের কেনাবেচা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন আগের চেয়ে ঢাকার বাইরে থেকে খুচরা বিক্রেতারা কম আসছেন। এ কারণে চকের পাইকারি বেচাকেনায় মন্দা চলছে। এতে সার্বিকভাবে পণ্য বিক্রি কমে গেছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ।
পণ্য বেচাকেনা কম হওয়ার কারণ হিসেবে চকের ব্যবসায়ীরা বলেন, বড় বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নিজেরাই পরিবেশকের মাধ্যমে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন। আবার ঢাকার বাইরের অনেক ব্যবসায়ীও বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করছেন। তারা আর চকবাজারের দিকে চেয়ে নেই। যানজটের কারণেও ক্রেতারা এখানে আসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন, যদিও এ বিষয়ে ভিন্নমতও আছে। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলছেন, বছরের শুরুর দিকের ব্যবসা একটু ঢিমেতালেই চলে। ঈদ ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান সামনে রেখে বেচাকেনা বাড়ে।
সম্প্রতি চকবাজার এলাকা পরিদর্শন করে দেখা যায়, পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে দিয়ে চকবাজারে যেতেই উর্দু সড়ক পর্যন্ত রিকশাজট। চকবাজারের চারপাশে শাহি মসজিদ, ওয়াটার ওয়ার্কস ও চক সার্কুলার সড়কেও একই অবস্থা দেখা গেছে।
চকবাজারে বিভিন্ন দোকানে দু-চারজন করে ক্রেতা ইমিটেশন অলঙ্কার, চুড়ি, ব্যাগ, তালাচাবি, টুথব্রাশ, সাবান, কটনবাড, ক্লিপসহ বিভিন্ন পণ্য কেনাকাটা করছেন। বিভিন্ন দোকানে অন্তত আট ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের সাতজনই ঢাকার বিভিন্ন এলাকার খুচরা ব্যবসায়ী। তবে অধিকাংশ দোকানেই উল্লেখ্যযোগ্য কোনো ক্রেতা দেখা যায়নি।
ব্যবসায়ীরা জানান, চকবাজারের আমদানিকারকেরা ভারত, চীন, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সরাসরি পণ্য কিনে আনেন। ব্যবসা কেমন চলছেÑএ প্রশ্ন করলে চকবাজারের রায়হান স্টোরের স্বত্বাধিকারী কাউছার আলম বলেন, ‘ব্যবসায় মন্দা চলছে। ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষ অনেক বিবেচনা করে জিনিসপত্র কিনছেন। এছাড়া বেচাকেনা এখন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান বা দিবসকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। ফলে বছরের নির্দিষ্ট কয়েক মাস বেচাকেনা হয়। বাকি সময় ব্যবসায় লোকসান গুনতে হয়।
চকবাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, এ বাজারের সবচেয়ে বড় সমস্যা যানজট। চিরচেনা এ দৃশ্যপটে স্থানীয় সবাই মোটামুটি অভ্যস্ত। কিন্তু ঢাকার বাইরের ক্রেতারা এতে খুবই বিরক্ত। মালামাল কিনতে এসে যানজটে আটকে থেকে তাদের অনেক সময় নষ্ট করতে হয়। এতে চকবাজারে দিনে দিনে ক্রেতাদের সংখ্যা কমছে। আগের তুলনায় এখন বেচাকেনা হয় এক-চতুর্থাংশ।
চকবাজারের বাংলাদেশ মনিহারি বণিক সমিতি সূত্র জানায়, চকে পাইকারি দোকান আছে প্রায় ৪০০। কিন্তু চকবাজারকে কেন্দ্র করে আশপাশে আরও কয়েক হাজার দোকান গড়ে উঠেছে। এ কারণেও চকের ক্রেতা কমে গেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মনিহারি বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আনিসুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, চকবাজারে আগের মতো রমরমা ব্যবসা-বাণিজ্য আর নেই। এখন দেশের জেলা শহরগুলোতে অনেক বড় বড় পাইকারি মার্কেট ও সুপারশপ গড়ে উঠেছে। আমদানিকারকের সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে। তাই ঢাকার বাইরের অনেক ব্যবসায়ীই এখন আর এখানে আসেন না। তিনি বলেন, আগে দেশের প্রায় সব জেলার খুচরা দোকানিরা চকবাজারে কেনাকাটা করতেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এখন পুরান ঢাকার বিকল্প বাজার ধরছেন।
উল্লেখ্য, চকবাজারের সূচনা হয়েছিল মুঘল আমলে। আর তখন থেকেই ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল এ চকবাজার। ব্যবসার পাশাপাশি এ চকবাজারে আছে হোসেনি দালান, বড়কাটরা, ছোটকাটরা কিংবা শাহি মসজিদের মতো নানা ধরনের স্থাপত্যকর্মও।
তবে মুঘল আমলের ৪০০ বছর পর এখন ঢাকা অনেক বিস্তৃত হয়েছে সব দিকেই। ব্যবসায়িক বিবেচনায় গুরুত্ব হারিয়েছে চকবাজার। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর ব্রিটিশ, পাকিস্তান কিংবা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ আমলেও এর ভেতরকার কোনো পরিবর্তন হয়নি, যদিও জনসংখ্যা আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে। রাস্তাঘাট-অলিগলি সেই সরুই রয়ে গেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক একেএম শাহনেওয়াজ চকবাজার নিয়ে বলছেন, ‘চক’ শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ থেকে। বাণিজ্যিক গুরুত্ব নিয়েই গড়ে উঠেছে চকবাজার। মুঘলরা আসার পর থেকে চকবাজার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ১৭ শতকে। পরে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবেই দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু চকবাজারের রাস্তাঘাট নিয়ে ভবিষ্যৎ চিন্তা কেউ করেনি। একসময় বিয়ের কেনাকাটার প্রধান বাজার ছিল চকবাজার। এখন সেই বাজার দখল করেছে এলিফ্যান্ট রোডের আশেপাশের দোকানগুলো।