সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: জাহাজ ভাঙা, পোশাক, ইস্পাত ও ট্রেডিং খাতের চট্টগ্রামের শতাধিক ঋণখেলাপি গ্রেপ্তার এড়াতে বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর কিছু খেলাপি দেশে আত্মগোপনে আছেন। সময়মতো তাদের গ্রেপ্তার করতে না পারায় বিচার কার্যক্রম ব্যাহত ও মামলাজট হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংকিং কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এসব বিবেচনায় দণ্ডিত ঋণখেলাপিদের গ্রেপ্তারে চট্টগ্রাম মহানগর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দিয়েছেন অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান আদালত।
চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত ১০ মাসে আদালত ১ হাজার ৩৭৩টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। কিন্তু ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে এই আদালত থেকে ইস্যুকৃত গ্রেপ্তারি পরোয়ানাগুলো যথাসময়ে তামিল হচ্ছে না। আর বেশিরভাগ আসামিদের গ্রেপ্তার না করায় মামলায় জট তৈরি হচ্ছে। এতে এসব মামলা যথাসময়ে নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে ঋণখেলাপিদের গ্রেপ্তার না করায় বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না। তাই এই আদালত থেকে ইস্যু করা চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের আওতাধীন থানাগুলোতে পেইন্ডিং থাকা ওয়ারেন্টগুলো তামিল নিশ্চিত করতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের জাহাজ ভাঙা, পোশাক, ইস্পাত ও ট্রেডিং খাতের শতাধিক ঋণখেলাপি গ্রেপ্তার এড়াতে বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর কিছু খেলাপি দেশে আত্মাগোপনে আছেন। এর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ও এইচএম গ্রুপের চেয়ারম্যান হারুন উর রশিদ। তার মালিকানাধীন এইচআর গ্রুপের সহযোগী রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এইচ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড, ন্যাশনাল আয়রন অ্যান্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, রুবাইয়া প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, চিটাগং ইস্পাত লিমিটেড, এইচ স্টিল ও আমানত স্টিল লিমিটেডের নামে অগ্রণী, সাউথইস্ট, মার্কেন্টাইল, এনসিসি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এক্সিম, আল-আরাফাহ্, রূপালী, যমুনা, প্রাইম, শাহ্জালাল ইসলামী ও জনতা ব্যাংকসহ মোট ২২টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় এক হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আছে।
ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ না করে গ্রুপের কর্ণধার হারুনুর রশিদ ও অন্যান্য পরিচালকরা আড়ালে চলে যান। তার বিরুদ্ধে একাধিক ওয়ারেন্ট রাজি আছে। শুধু তিনি নন, ইস্পাত ও জাহাজ ভাঙা ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান শাহীনের সিলভিয়া গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এক হাজার কোটি খেলাপি, জাহাঙ্গীর আলমের মালিকানাধীন মাবিয়া গ্রুপ বিভিন্ন ব্যাংকের খেলাপি পাওনা প্রায় এক হাজার কোটি টাকা, ইমাম গ্রুপের মোহাম্মদ আলীর খেলাপি ৮০০ কোটি, জয়নাল আবেদিনের ম্যাক গ্রুপের খেলাপি ৮০০ কোটি, পোশাক ও জাহাজ ভাঙা ব্যবসায়ী আবদুল হাইয়ের পলাতক লিজেন্ড হোল্ডিংসে ৬০০ কোটি, খাতুনগঞ্জ এলাকার ব্যবসায়ী ইয়াসির এন্টারপ্রাইজের মোজাহের হোসেন ৬০০ কোটি খেলাপি, মিডল্যান্ড ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ইসা বাদশা মহসিনের বাদশা গ্রুপের ৫৫০ কোটি, চট্টগ্রাম ইপিজেটের বিনিয়োগকারী নাজমুল আবেদিন ব্র্যাক ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন ২৮৫ কোটি টাকা, একই সঙ্গে ২২২ কোটি টাকা বন্ড সুবিধা অপব্যবহার, পোশাক কারখানার এক হাজার ৩৭২ শ্রমিকের বেতন-ভাতা, বেপজার পাওনা, অ্যাকসেসরিজ সাপ্লায়ারদের আরও অন্তত ৫৩ কোটি টাকা না দিয়েই গোপনে ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী এই ব্যবসায়ী, সাহেদ মিয়ার তানিয়া এন্টারপ্রাইজের ২১২ কোটি, দিদারুল ইসলামের শীতল এন্টারপ্রাইজের ১০২ কোটি, শরফুদ্দীন আহমেদের ফরচুন স্টিলের ১৩৯ কোটি, শফিকুল ইসলামের শফিক স্টিলের ১৩১ কোটি, সুপার সিক্স স্টিলের ১০৫ কোটি, মাস শিপ ব্রেকিংয়ের ২০০ কোটিসহ দুই শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকগুলো প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা খেলাপি পাওনা আছে। যদিও এসব প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ আছে। আর ঋণখেলাপিরা দেশে ও বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন, নব্বইয়ের দশকে ব্যবসায়িক সাফল্যে শীর্ষ আমদানিকারক হিসেবে পরিচিত পান খাতুনগঞ্জভিত্তিক ইমাম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ আলী। আর এখন তিনি ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের একজন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাংকের একাধিক চেক প্রতারণা ও খেলাপি মামলা বিচারাধীন আছে। এর মধ্যে চেক প্রতারণার একাধিক মামলায় জেল ও কয়েক কোটি টাকা আর্থিক জরিমানাও করেন আদালত। কিন্তু আসামি আত্মগোপনে থাকায় তিন বছরের অধিক সময়েও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এমনকি এ খেলাপি ব্যবসায়ীর প্রকৃত অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় এটা নিশ্চিত করে, গত ১৯ নভেম্বর ২০১৯ সালে সড়ক পথে ভারতে চলে যান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, নিয়মানুসারে খেলাপি গ্রাহকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। খেলাপি পাওনা আদায়ে বন্ধকি সম্পত্তি নিলাম করা হয়। কিন্তু কেউ কিনতে আগ্রহী হন না। পরে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা হয়; যা সময়সাপেক্ষে শেষ হয়। এর মধ্যে কোনো কোনো গ্রাহক পাওনা পরিশোধে আগ্রহ দেখান। তখন মামলার প্রক্রিয়া ধীরগতি চলে। আবার বিভিন্ন ধরনের চাপও থাকে। সব মিলিয়ে মামলা প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে হয়। আবার অনেক সময় আইনপ্রয়োগ সংস্থাকে এড়িয়ে খেলাপিরা পালিয়ে যান। ফলে মামলা নিষ্পত্তি হতে সময় লাগে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর শেয়ার বিজকে বলেন, ‘অর্থঋণ আদালতের আসামিরা তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়টি আগেই জেনে যায়। ফলে পুলিশ অভিযান পরিচালনার আগেই তারা পালিয়ে যান।’
বাংলাদেশ ব্যাংককে নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, অর্থঋণ আদালত আইনের ৩৮ ধারা এবং ৪৫ ধারায় ডিক্রিকৃত টাকা পরিশোধে আপস মীমাংসার সুযোগ রাখা হলেও ৪৫(২) ধারায় আইনে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রে নমনীয়তা এবং উদাসীনতা দেখায়; যা ব্যাংক খাতকে নাজুক অবস্থায় নিয়ে গেছে। জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি আরও বাড়ানো প্রয়োজন।