Print Date & Time : 25 June 2025 Wednesday 8:29 pm

চট্টগ্রামে আক্রান্তের ৫১ শতাংশই তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: শিল্প-বাণিজ্যের শহর চট্টগ্রাম। এ শহরের বাণিজ্যিক কর্মচাঞ্চল্য অনেকটাই স্থবির। গতকাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মোট সংখ্যা এক হাজার ৯৮৫। এর মধ্যে ২১ থেকে ৪০ বছর বয়সি কভিড-আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক হাজার ১৪, যা মোট আক্রান্তের ৫১ শতাংশ। অর্থাৎ করোনায় বেশি আক্রান্ত হয়েছে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। আর প্রতিনিয়ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়া চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে শীর্ষে আছে এসব তরুণ জনগোষ্ঠী। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত চরম উৎকণ্ঠায় দিনাতিপাত করছে অর্থনীতির সম্ভাবনাময় চালকরা।

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা শুরু হয় ২৫ মার্চ। আর প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় এর ঠিক ১০ দিন পর ৩ এপ্রিল। এক মাস পর ৪ মে চট্টগ্রামে মোট করোনা পজিটিভ শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৯। এরপর মাত্র ২৩ দিনে চট্টগ্রামে করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয় এক হাজার ৮৯৬ জন।

অর্থাৎ ২৩ দিনে কভিড-আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ২১ গুণ। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত মোট রোগীর সংখ্যা হয়েছে এক হাজার ৯৮৫। এর মধ্যে এক বছর থেকে ১০ বছর বয়সি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪৯ জন, আর ১১ থেকে ২০ বছর বয়সি ১৪০ জন, ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সি ৪৮১ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সি ৫৩৩ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সি ৩৪৭ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সি ২৬৮ জন এবং ৬১ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে রয়েছে ১৬৭ জন।

এদিকে চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত করোনা চিকিৎসার জন্য বেড আছে ৩১৫টি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ১০০ সিটের আইসোলেশন ও ১০ সিটের আইসিইউ ওয়ার্ড এবং ফৌজদারহাটের বিশেষায়িত হাসপাতাল বিআইটিআইডিতে ৩০ সিটের আইসোলেশন ওয়ার্ড ছাড়াও একই এলাকায় ফিল্ড হাসপাতালে ৫০ সিট ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩০ সিটের অবজারভেশন ওয়ার্ড রয়েছে।

এসব আপাতত করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে, যদিও আক্রান্তের তুলনায় চিকিৎসার বেড কম হওয়ায় দৃশ্যমান উপসর্গ না থাকলে রোগীকে বাড়িতে আইসোলেশনে রাখা হচ্ছে। আর হাসপাতালে ২৩১ জন আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছে।

এ পরিসংখ্যান অনুসারে ২১ থেকে ৪০ বছর বয়সি কভিড-আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক হাজার ১৪ জন, যা মোট আক্রান্তের ৫১ শতাংশ। অপরদিকে মোট আক্রান্তের মধ্যে পুরুষ এক হাজার ৫০৪ জন ও নারী ৪৮১ জন। অর্থাৎ আক্রান্ত পুরুষের হার ৭৬ শতাংশ এবং আক্রান্ত নারীর হার ২৪ শতাংশ। আবার মোট আক্রান্তের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরের বাসিন্দা এক ৫৫৯ জন ও উপজেলায় ৪২৬ জন। অর্থাৎ শহরের আক্রান্তের হার ৭৯ শতাংশ এবং উপজেলা বা গ্রামে আক্রান্তের হার ২১ শতাংশ।

এদিকে শ্রমবাজারের ওপর কভিড-১৯ মহামারির প্রভাব নিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ তরুণ কর্মজীবীদের বিষয়ে উদ্বেগজনক চিত্র প্রকাশ করেছে। ‘আইএলও মনিটর: কভিড-১৯ অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড অব ওয়ার্ক’-এর চতুর্থ সংস্করণের প্রতিবেদন অনুসারে, কভিড-১৯ মহামারির কারণে বাংলাদেশের তরুণদের প্রতি ছয়জনে একজন কর্মহীন হয়ে পড়েছে।

আর যারা এখনও কাজ করছে তাদের কর্মঘণ্টা ২৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আরও বলা হয়, চলমান মহামারিতে তরুণরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তিনভাবে-একদিকে তারা কাজ হারাচ্ছে, অন্যদিকে তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যাহত হচ্ছে। এটা আবার তাদের চাকরির বাজারে প্রবেশ ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এ মহামারি দুনিয়ার তরুণদের প্রতি বৈষম্যমূলকভাবে আঘাত হানছে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ বলছে, গত
ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব ধারাবাহিকভাবে ও দ্রুতগতিতে বাড়ছে, আর এক্ষেত্রে তরুণদের চেয়ে তরুণীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার বর্তমানে অন্য যেকোনো বয়সভিত্তিক গ্রুপের চেয়ে বেশি। এখন দুনিয়াজুড়ে প্রায় ২৭ কোটি তরুণ কর্মহীন এবং তারা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্স বিভাগ থেকে পাস করা বেসরকারি নন-এমপিও কলেজে কর্মরত মাশিয়াত আনজুম (ছদ্মনাম) বলেন, ‘করোনার কারণে কলেজ থেকে গত তিন মাস বেতন পাননি। এমনকি কলেজ থেকে একবার যোগাযোগও করা হয়নি! মানুষ হিসেবে কেমন আছি, তাও জানতে মনে হয় তাদের আগ্রহও নেই! শুনেছি এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বেতন পেয়েছেন। আমরা যারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত তারা বেতন পাননি। এটা অমানবিক। এখন ভাবছি পেশা পরিবর্তন করব।’

ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান এসএম নাজের হোসাইন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক। করোনা-আক্রান্তদের ৫১ শতাংশই তরুণ। তার অর্থ এটাই দাঁড়াল, তরুণরা স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। আর যদি এটা সত্যি হয়, তাহলে আমাদের জন্য আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। কারণ আজকের তরুণরাই আগামীকাল দেশকে নেতৃত্ব দেবে। তাই তরুণসমাজকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে এবং এ বিষয়ে নানা অনুশাসন মানতে বাধ্য করতে হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়ে বিশেষ কাউন্সেলিংয়ের উদ্যোগ নিতে হবে।’

এ বিষয়ে অর্থনীতি বিশ্লেষক, বিভিন্ন ট্রেডবডি লিডার ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্ণধার শেয়ার বিজকে বলেন, ‘গত দুই মাস করোনা সংক্রমণ এমনিতে আমাদের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক গতিশীলতাকে স্থবির করে দিয়েছে। প্রতিনিয়ত আমাদের ভোগান্তিতে ফেলছে। একদিকে আর্থিক লোকসান তৈরি করছে, অন্যদিকে মেধাবী তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে আক্রান্ত করছে। অথচ তরুণ জনগোষ্ঠী তো আমাদের অর্থনীতি প্রতিনিয়ত গতিশীল রেখেছে। তাদের কর্ম-উপযোগী হিসেবে তৈরি করতে তো আমাদের অনেক বিনিয়োগ করতে হয়েছিল। এ বয়সি জনগোষ্ঠীকে আরও সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি তদারকি সংস্থাগুলোকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।’

উল্লেখ্য, বুধবার (২৭ মে) চট্টগ্রামের চারটি ল্যাবে ৬০২টি নমুনা পরীক্ষায় ২১৫ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৮২ জন নগরের এবং ৩৩ জন বিভিন্ন উপজেলার। সর্বশেষ শনাক্ত হওয়া ২১৫ জনসহ চট্টগ্রামে মোট করোনা পজিটিভ এখন দুই হাজার ২০০ জন।