সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: আগ্রহী ক্রেতা না পেয়ে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় পচা চামড়ার স্তূপ রেখে ফিরে যান ঘরে। এসব স্তূপে পাওয়া যায় প্রায় এক লাখ পিস চামড়া। আর প্রতিটি চামড়ার গড় মূল্য ৫০০ টাকা হলেও এসব কাঁচা চামড়ায় নষ্ট হয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা, যা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের প্রায় একদিন ব্যয়ে এসব পচা চামড়া হালিশহর আনন্দবাজার ও আরেফিন নগরের আবর্জনার ভাগাড়ে ফেলতে হয়, যা নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ঈদের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে রাত আড়াইটা পর্যন্ত ২০০ শ্রমিক ও আটটি পে-লোডারের সাহায্যে ৩২টি ট্রাকে ৯০ ট্রিপে এক লাখ পচা চামড়া অপসারণ করা হয়। এসব নগরের কাঁচা চামড়ার প্রধান বাজার হামজারবাগ, আতুরার ডিপোসহ বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পচা চামড়াগুলো সরিয়ে নেয় চসিকের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। এ সময়ে এক হাজার কেজি ব্লিচিং পাউডার ছিটানো হয় পচা চামড়া অপসারণের জায়গাগুলোয়।
জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতি সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলায় এ বছরের প্রায় আট লাখ পশু কোরবানি হয়। এর মধ্যে নগরে প্রায় এক লাখ ৮০ হাজার গরু ও ৫০ হাজার ছাগল জবাই হয়। আর জেলার বিভিন্ন থানায় হয় প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখেরও বেশি।
সংশ্লিষ্ট আড়তদাররা জানান, চট্টগ্রামে এক সময়ে ২২টি ট্যানারি ছিল। বর্তমানে টিকে আছে মদিনা ট্যানারি ও রিফ লেদার। এর মধ্যে ইটিপি না থাকায় মদিনা ট্যানারির কার্যক্রম বন্ধ আছে। রিফ লেদার পাঁচ-সাত শতাংশ চামড়া কিনে থাকে। অবশিষ্ট চামড়া ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করতে হয়। কিন্তু এবার তাদের আগ্রহ না থাকায় ইচ্ছা থাকার পরও চামড়া কিনতে পারেননি তারা।
তারা বলেন, প্রথমে ৩০০ টাকায় বড় চামড়া কিনেছিলেন। এরপর ২০০-১০০ টাকায় নেমে আসে। তারপর ক্রেতার দেখা মেলেনি বাজারে। চামড়া নিয়ে যেসব ট্রাক এসেছিল অনেকে ভাড়াটাও তুলতে পারেনি চামড়া বেচে। পরে একপর্যায়ে চামড়ার স্তূপ, ট্রাকভর্তি চামড়া ফেলেই পালিয়ে যান তারা। এছাড়া চট্টগ্রামের আড়তদাররা ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে গত বছরের যে বকেয়া টাকা পাওনা ছিল তার সিকি ভাগও দেননি তারা। এর ফলে তারা পর্যাপ্ত লবণ, শ্রমিক জোগাড় করতে পারেননি। ফলে কিছু চামড়া সংগ্রহ করে তারা বাজার থেকে সরে পড়েন।
কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবদুল কাদের বলেন, ‘প্রথম দিন গরু, মহিষ ও ছাগলের প্রায় ৭৫ শতাংশ চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতি বর্গফুট লবণ দেওয়া চামড়া ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় কেনা হচ্ছে। ছোট প্রতি পিস চামড়া ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, মাঝারি আকারের চামড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় কিনছি। এছাড়া মহিষের চামড়া প্রতি বর্গফুট ২০-২৫ টাকা, ছাগলের চামড়া প্রতি বর্গফুট ১০ টাকায় কেনা হয়।’
ব্যাংকার ও বাজার বিশ্লেষকরা বলেন, আগ্রহী ক্রেতা না পেয়ে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় পচা চামড়ার স্তূপ রেখে ফিরে যান ঘরে। এসব স্তূপে পাওয়া যায় প্রায় এক লাখ পিস চামড়া। আর প্রতিটি চামড়ার গড় মূল্য ৫০০ টাকা হলেও এসব কাঁচা চামড়ায় নষ্ট হয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। অথচ এক জোড়া চামড়ার জুতা কিনতে গেলে কমপক্ষে এক হাজার টাকা ব্যয় করতে হবে। এ ঘটনা অনেক বেদনাদায়ক। এভাবে মহামূল্যবান চামড়াশিল্প ধ্বংশ হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
এ বিষয়ে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘চামড়া পচবে, সেই চামড়া চসিককে অপসারণ করতে হবে এ ধরনের কোনো ভাবনাই আমাদের কোনো কালে ছিল না। আমরা সাধারণত কোরবানির দিন পশুর নাড়ি-ভুঁড়ি, বর্জ্য, রক্ত, উচ্ছিষ্টাংশ দ্রুত অপসারণের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। সেই লক্ষ্য আমরা অর্জনও করেছি। কিন্তু পচা চামড়া অপসারণের কাজটি ছিল নতুন একটি চ্যালেঞ্জের। এ কাজটিও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আমরা সম্পন্ন করেছি। আমরা কোরবানির পরদিন থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত আতুরার ডিপো-হামজারবাগ এলাকা থেকে এক লাখ, বহদ্দারহাট থেকে ৯ হাজার ও আগ্রাবাদ থেকে ১২ হাজারের বেশি পচা চামড়া নগরের দুটি আবর্জনার ভাগাড়ে ফেলেছি।’
তিনি আরও বলেন, চামড়ার সরকার নির্ধারিত দাম না পাওয়ার পেছনে কোনো ব্যক্তি বা সংঘটিত চক্রের দূরভিসন্ধি আছে কি না খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।