নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর, শিল্প ও বাণিজ্যের শহর চট্টগ্রাম। ফলে চট্টগ্রামসহ সারাদেশের মানুষের ব্যবসা ও বাণিজ্যে অংশগ্রহণ বেশি। কিন্তু একটি মাত্র অর্থঋণ আদালত হওয়ায় এখানে মামলার চাপ বেশি। এতে খেলাপিদের কাছ থেকে খেলাপি ঋণ আদায় ও বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনায় বেগ পেতে হয়। তাই খেলাপি ঋণ আদায় ও বিচারিক কার্যক্রম দ্রুত শেষ করার জন্য চট্টগ্রামে আরও দুটি অর্থঋণ আদালত গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত বছর চট্টগ্রামে চারটি নতুন অর্থঋণ আদালত গঠনে নির্ধারিত পদ সৃজনের জন্য আইন মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়। ওই প্রস্তাব পর্যালোচনা শেষে সম্প্রতি ঢাকায় ৩টি ও চট্টগ্রামে ২টি নতুন অর্থঋণ আদালত গঠনের বিষয়ে ৩০টি পদ সৃজন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠানো হয়েছে। প্রতিটি আদালতের জন্য প্রস্তাবিত পদের মধ্যে রয়েছেÑযুগ্ম জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারক, প্রতিটি আদালতের জন্য একজন করে সাঁটমুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর, বেঞ্চ সহকারী, ড্রাইভার, জারিকারক ও অফিস সহায়ক। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন শেষে ফাইলটি সচিব কমিটিতে পাঠানো হবে।
সেখানে অনুমোদনের পর ফাইলটি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে অনুমোদনের জন্য যাবে। এরপর অর্থ মন্ত্রণালয় ৩০টি পদের বেতন স্কেল নির্ধারণসহ পৃষ্ঠা অঙ্কন করবে। পরে সরকারি আদেশ (জিও) জারি করা হবে। আশা করা হচ্ছে, দুই-তিন মাসের মধ্যে প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন হবে। এই আদালতগুলো গঠন করা হলে খেলাপি ঋণ আদায়-সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে গতি বাড়বে।
চট্টগ্রামে অর্থঋণ আদালত সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে মাত্র একটি অর্থঋণ আদালত রয়েছে। সেখানে প্রায় পাঁচ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে তিনটি মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। গত ২০২২ ও ২০২৩ সালের ২৪ মাস ও চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে মামলা দায়ের হয়েছে ৪ হাজার ২২০টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ৩ হাজার ৮১৯টি। ১০ বছরের অধিক পুরোনো মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে ১৭৭টি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে মামলা দায়ের হয়েছে ৩৯১টি। তার মধ্যে অর্থঋণ মামলা ২০৮টি, জারি ১৬৭টি ও মিস মামলা ১৬টি।
চার মাসে নিষ্পত্তি করা হয় ৪১৬টি মামলা, যার মধ্যে ১০ বছরের অধিক পুরোনো মামলা ছিল ১৭টি। নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে অর্থঋণ মামলা ২৯২, জারি মামলা ১১৫ ও মিস মামলা ৯টি। এর আগে ২০২৩ সালে মামলা দায়ের হয়েছে ২ হাজার ২৭১টি। এর মধ্যে অর্থঋণ মামলা ৭৮৭টি, জারি ১৩৯৯টি ও মিস মামলা ৮৫টি। ওই বছর নিষ্পত্তি করা হয় ১৬৮০টি মামলা, যার মধ্যে ১০ বছরের অধিক পুরোনো মামলা ছিল ৯২টি। নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে অর্থঋণ মামলা ১ হাজার ৩৫৫, জারি মামলা ২৫১ ও মিস মামলা ৭৪টি। ওই বছর অর্থঋণ মামলা বাবদ আদায় করা হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। এছাড়া ২০২২ সালে মামলা দায়ের হয়েছে ১ হাজার ৫৫৮টি।
এর মধ্যে অর্থঋণ মামলা ৯১৭টি, জারি ৫৫১টি ও মিস মামলা ৯০টি। ওই বছর নিষ্পত্তি করা হয় ১ হাজার ৭২৩টি মামলা; যার মধ্যে ১০ বছরের অধিক পুরোনো মামলা ছিল ৬৮টি। নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে অর্থঋণ মামলা ১ হাজার ২৮৩, জারি মামলা ৩০৫ ও মিস মামলা ১৩৫টি। ওই বছর অর্থঋণ মামলা বাবদ আদায় করা হয়েছে ৯০০ কোটি টাকা। অপরদিকে ২০২১ সালে অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের হয়েছে ১ হাজার ২৩৪টি। এর মধ্যে অর্থ ঋণ মামলা ৯০৫টি, জারি ২৬৯টি ও মিস মামলা ৬০টি। ওই বছর নিষ্পত্তি করা হয় ৭৯৯টি মামলা, যার মধ্যে ১০ বছরের অধিক পুরোনো মামলা ছিল ৩৬টি। নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যেÑঅর্থঋণ মামলা ৫১৯, জারি মামলা ২৩০ ও মিস মামলা ৫০টি। ওই বছর আদায় করা হয়েছে অর্থঋণ মামলা বাবদ প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তির পেছনে বিচারক মুজাহিদুর রহমানের ভূমিকাই বেশি বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। তারা জানিয়েছেন, ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে তিনি এ আদালতের বিচারক হিসেবে যোগদান করার পর আদালতের মামলাজট কমিয়ে আনতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেন। এতে গ্রেপ্তারের ভয়ে অনেক ঋণখেলাপি মামলা নিষ্পত্তিতে এগিয়ে আসেন। এ ছাড়া যেসব মামলায় বন্ধকি সম্পত্তি আছে, সেগুলোয় রিসিভার নিয়োগ করেন। অন্যদিকে তিনি দেখেছেন, যেসব ঋণের বিপরীতে কোনো সম্পত্তি বন্ধক থাকে না, সে ক্ষেত্রে বিবাদীরা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে দেশত্যাগের চেষ্টা করেন। এ জন্য তিনি ওইসব ঋণখেলাপির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন।
চট্টগ্রামে আইনজীবী সরওয়ার কামাল শেয়ার বিজকে বলেন, অর্থঋণ আদালত আইন অনুযায়ী মামলা নিষ্পত্তি করার সর্বোচ্চ সময়সীমা হচ্ছে ১২০ দিন। অর্থঋণ আদালত আইন হয়েছিল, দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি হবে, সেটি কিন্তু পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কারণ চট্টগ্রামের একটি মাত্র আদালত আছে। স্বাভাবিকভাবে যথাসময়ে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না কিংবা ঋণের অর্থ দ্রুততম সময়ে আদায়ও হচ্ছে না। তাই দ্রুত সময়ে নতুন আদালত সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে প্রিমিয়ার লিজিং ও ফাইন্যান্সের চট্টগ্রাম শাখার ব্যবস্থাপক শাজামান শেয়ার বিজকে বলেন, আসামিরা যতই প্রভাবশালী হোক, ছাড় দেননি বিচারক। বড় ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সরকার তৎপর। এ লক্ষ্যে ঢাকায় ৩টি ও চট্টগ্রামে ২টি নতুন অর্থঋণ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হবে।