চট্টগ্রামে ওষুধ শিল্পে নতুন বিনিয়োগ আসছে না

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম। ওষুধ শিল্প স্থাপনের জন্য উপযুক্ত জমি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ সস্তা শ্রমের সুযোগ রয়েছে এখানে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে চলছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। কিন্তু গত ১০ বছরে এখানে ওষুধ শিল্পকারখানা স্থাপনে নতুন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। উল্টো একে একে বন্ধ হয়েছে ৩০টির অধিক ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। অথচ অন্যান্য জেলায় ওষুধ কারখানা স্থাপন ও এ খাতে বিনিয়োগ অব্যাহত রয়েছে। আর রপ্তানিতেও দেশের ওষুধ শিল্প দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে দুই শতাধিক ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে এর সবগুলো উৎপাদনে নেই। উৎপাদনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশ কয়েকটি বিশ্বের ১৪৮টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে আসছে। দুই হাজার ৮০০টির বেশি আইটেমের ওষুধ রপ্তানি করে বাংলাদেশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ৪৬১ টাকার ওষুধ রপ্তানি হয়েছে। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি ওষুধ রপ্তানি করেছে। কিন্তু চট্টগ্রাম অঞ্চলে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে বন্ধ হয়ে হচ্ছে। বর্তমানে ১০টির মতো চালু আছে। আর বন্ধ হয়েছে প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ২০১৮ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়ার তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয় বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন (জিএসকে)। কোম্পানিটির বিশাল বাজার ছিল। কিন্তু এ কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামের সম্ভাবনা হাতছাড়া হয়ে গেছে।

তার আগে চট্টগ্রামের কালুরঘাটের বিসিক শিল্প এলাকায় ‘থেরাপিউটিকস বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামের ওষুধ কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। একইভাবে ম্যাফনাজ ফার্মাসিউটিক্যালস, ইউনাইটেড ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড, সিটি ফার্মাসিউটিক্যালস, স্ট্যান্ডার্ড ল্যাবরেটরিজ, ইস্টার্ন হার্বাল প্রোডাক্টস ও দেশ ল্যাবরেটরিজ, ওরিসন ফার্মাসিউটিক্যালস, জনতা ফার্মাসিউটিক্যালস, এপসিস ফার্মাসিউটিক্যালস, প্রিমিয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, ভাইটাল ফার্মাসিউটিক্যালস, ফ্লোরা ফার্মাসিউটিক্যালস, নিকন ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড, উদয়ন ফার্মাসিউটিক্যালস, ম্যাগ ল্যাবরেটরিজ বিন্দু মাধব শাহ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড, শরত রক্ষিত ঔষধালয়, শান্তি আয়ুর্বেদীয় ঔষধালয় ইত্যাদি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া অনেকগুলো আয়ুর্বেদিক এবং ইউনানি ঔষধালয়ও বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে চালু থাকা কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে রেকিট বেনকিজার বাংলাদেশ লিমিটেড, রয়েল ফার্মাসিউটিকালস লিমিটেড, এলবিয়ন লাবরেটরিজ লিমিটেড, ইউনাইটেড কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড,

অরবিট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং ফার্মিক ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, দেশের প্রধানতম বন্দর ও বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রাম। এ শহরের বাণিজ্যিক কর্মচাঞ্চল্য বাড়ানোর জন্য স্থাপন করা হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল। এছাড়া দেশের প্রথম টানেলসহ অনেকগুলো অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। পাশাপাশি বিনিয়োগ সহায়ক মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এবং চট্টগ্রাম বন্দর সক্ষমতা ও সুবিধা বাড়ানো কাজ চলছে। কিন্তু এত সম্ভাবনার পরও চলমান করোনা ভাইরাস সংক্রমণে গত ২০২০-২১ অর্থবছরের স্থানীয় বিনিয়োগ হয়েছে দুই হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরে ছিল তিন হাজার ২২৭ কোটি টাকা। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ছিল ছয় হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। আর খাতভিত্তিক বিনিয়োগ চিত্র অনুসারে, জাহাজ ভাঙা, পোশাক কারখানা, ডাল মিল, এলপি সিলিন্ডার নির্মাণ, লবণ ক্রাশিং ও কৃষি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমদানি করা কাঁচামাল দিয়ে তৈরি হয় ওষুধ। পরবর্তীতে তা দেশব্যাপী বিপণন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়। বড় বড় কারখানাগুলোয় উৎপাদিত ওষুধ বিদেশে রপ্তানিও করা হয়। বর্তমানে দেশের ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজারের ৯৮ শতাংশ জোগান দিচ্ছে দেশীয় ওষুধ কোম্পানি। এর বাইরে বিপুল পরিমাণ ওষুধ রপ্তানিও করা হয়। কিন্তু কাঁচামাল আমদানি থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ বা বিদেশে রপ্তানির পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয় ঢাকা থেকে। সব কার্যক্রম ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় বহুমুখী সম্ভাবনা থাকার পরও চট্টগ্রামের ওষুধ কারখানাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেছে।

চট্টগ্রামে সম্ভাবনার থাকার পরও নতুন ওষুধ কারখানা স্থাপন ও বিনিয়োগ না হওয়া বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের গভর্নিং বডির সদস্য মাহবুবুল আলম বলেন, চট্টগ্রাম এখন বিনিয়োগের জন্য তৈরি। এখানে বন্দর সুবিধা আগের চেয়ে বেড়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোগত সুবিধাও বেড়েছে; আরও বাড়বে। জমিরও সংকট নেই। যেখানে বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানি করছে, সেখানে চট্টগ্রাম অঞ্চলে শিল্প স্থাপনে ব্যাপক সম্ভাবনা তো আছেই। কিন্তু চট্টগ্রামে বিনিয়োগ না হওয়ায়টা দুঃখজনক। ওষুধ খাতে বিনিয়োগ না হওয়ার বিষয়ে আমাদের গবেষণা দরকার। আমার মনে হয়, কেন্দ্রীকারণ হওয়ায় চট্টগ্রামে ওষুধ শিল্প বিকাশিত হয়নি। সর্বশেষ তো জিএসকেও ব্যবসা বন্ধ করে দিল। এটা আসলে ভাবনার বিষয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, এ অঞ্চলের মানুষ স্টিল, সিমেন্ট, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ ভাঙা, ভোগ্যপণ্য আমদানি প্রভৃতিতে বেশি মনোযোগী। ফলে চট্টগ্রামে ওষুধ শিল্পে বিনিয়োগ হচ্ছে না। তবে বন্ধ হয়ে যাওয়া ৩০টি কারখানার বেশ কয়েকটি মান ধরে রাখতে না পারায় বন্ধ হয়ে গেছে। ওষুধ কারখানা পরিচালনার সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা রয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এসব নীতিমান প্রণয়ন করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি)। উৎপাদনে ব্যবহƒত যন্ত্রপাতির মান, উৎপাদিন ওষুধের মান ও বিপণন ব্যবস্থা কেমন হবে সবকিছুই জিএমপি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত। আর এ নীতিমালা অনুসরণ না করে কোনো কারখানাই চালু থাকার সুযোগ নেই।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০