সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম মহানগরীর আগ্রাবাদ সিডিএ তিন নম্বর সড়কে থাকেন ফ্যাশন ডিজাইনার ও উদ্যোক্তা রওশন আরা চৌধুরী। গত মাসে ঘূর্ণিঝড় মোরার প্রভাবে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় প্রথমবারের মতো তার পাঁচতলা ভবনের নিচতলা সপ্তাহ খানেক পানিতে ডুবে ছিল। এতে ভিজে নষ্ট হয় ডিজাইন হাউজের জন্য তৈরিকৃত কাপড়সহ সব ধরনের কাঁচামাল। পাশাপাশি আসবাবপত্রও নষ্ট হয়। সব মিলিয়ে এ উদ্যোক্তার প্রায় এক কোটি টাকা লোকসান হয়। শুধু তিনি নন, জলাবদ্ধতার কারণে এ ধরনের আর্থিক ক্ষতির শিকার চট্টগ্রাম মহানগরের ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন স্তরের নগরবাসী।
এদিকে গতকাল সোমবার অতিবৃষ্টির কারণেও চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি ও বহির্নোঙরের জাহাজ থেকে খোলা ও বস্তাবন্দি পণ্য খালাস বন্ধ ছিল। গত মাসে ঘূর্ণিঝড় মোরার প্রভাবে চট্টগ্রাম বন্দর দুদিন পরিচালন কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এ কারণে আমদানিকারক ও রফতানিকারকদের শত শত কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির শিকার হতে হয়। অন্যদিকে দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ-আছদগঞ্জ-চাক্তাই এলাকায় প্রতি বছর পূর্ণিমা ও অমাবস্যার জোয়ার ও জলাবদ্ধতায় শতকোটি টাকারও অধিক লোকসান গুনতে হয়।
এ প্রসঙ্গে ‘খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজ’-এর সাধারণ সম্পাদক ছগির আহমদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘চলতি বছরের এখনকার ব্যবসায়ীদের জলাবদ্ধতায় এখন পর্যন্ত ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এ ক্ষতির পরিমাণ বিগত বছরগুলোয় ১০০ কোটি টাকার বেশি ছিল। এছাড়া মোরা আঘাতে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে থাকা প্রায় ১০০ কাঁচা দোকানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ অর্ধকোটিরও বেশি।’
যানবাহন চালক ও মালিকরা জানান, জলাবদ্ধতা ও ভাঙাচোরা সড়কে গাড়ি চালালে বিভিন্ন যানবাহনের ইঞ্জিন, চেসিস, অ্যাঙ্গেলসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নষ্ট ও ভেঙে যায়। এছাড়া ভাঙাচোরা সড়কের কারণে বিভিন্ন সময় যানজটে পড়ে জ্বালানি ব্যয় বাড়ছে।
জলাবদ্ধতার কারণে নিচু এলাকার ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসান দিচ্ছে। আবাসিক এলাকার বাসাবাড়ির নিচতলার বাসিন্দাদের মূল্যবান জিনিসপত্র পানিতে নষ্ট হচ্ছে।
চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে গত ১৪ বছরে চসিক ৩০৪ কোটি টাকা ব্যয় করে। এরপরও এ সমস্যা থেকে মুক্তি পায়নি নগরবাসী। পাশাপাশি বহদ্দারহাট-সরাইপড়া নতুন খাল খননের জন্য ৩২৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত ৬০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে; যা ব্যয় হবে জমি অধিগ্রহণে।
সিটি মেয়র নাছির উদ্দীন বলেন, ১৯৯৫ সালে মহাপরিকল্পনায় নগর পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পর্কিত সব ধরনের নির্দেশনা ছিল। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে উপেক্ষা করা হয়েছে এ প্ল্যানের সুপারিশগুলো। ফলে আজ চট্টগ্রাম শহর জলাবদ্ধতা, যানজট ও বিশৃঙ্খলার শহরে পরিণত হয়েছে। এর জন্য তৎকালীন নীতিনির্ধারকদের অবহেলা, অদক্ষতাই মূল কারণ। আর ভোগান্তিতে আজকের সাধারণ জনগণ।
সচেতন নগরবাসীর অভিযোগ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে না ওঠা, খালে গভীরতা হ্রাস, নিয়মিত নদী খনন না করা, প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ভরাট করা ইত্যাদি কারণে বাড়ছে জলাবদ্ধতা। অপরদিকে বছরের পর বছর ধরে ওয়াসার পাইপলাইনের কাজ আর সিডিএর অপরিকল্পিত সমন্বয়হীন নির্মাণ এবং সংস্কারকাজের খোঁড়াখুঁড়ির ফলে দীর্ঘ দুর্ভোগের পাশাপাশি বৃষ্টিতে কার্পেটিং উঠে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। বেশ কিছু সড়কে যানবাহন চলাচল তো দূরের কথা, হেঁটে চলাও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। খানাখন্দে পড়ে বিকল হচ্ছে যানবাহনও। অনেক সময় যানবাহন চলাচলও বন্ধ থাকছে সাময়িক। প্রতিদিনই আহত হচ্ছেন অসংখ্য যাত্রী ও পথচারী।
চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ও নগর পরিকল্পনাবিদ শেয়ার বিজকে বলেন, সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যাচ্ছে শহরের রাস্তাঘাট। এতে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো প্রতিবছর এ কাজে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এ বছরে বর্ষা মৌসুম শুরুর আগের বৃষ্টিতেই ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় নগরবাসীকে বিপুল পরিমাণে আর্থিক ক্ষতি সাধন হয়েছে। এ আতঙ্ক প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফিরছে। তাদের শঙ্কা, পুরোমাত্রায় বর্ষা শুরু হলে নগরজীবনে ভোগান্তির অন্ত থাকবে না। এর জন্য বিদ্যমান অবস্থায় টেকসই ড্রেনেজ সিস্টেম গড়ে তোলার পাশাপাশি খালগুলো দখল ও ভরাটমুক্ত রাখতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবা সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তবেই জনগণের খরচ করা অর্থ কাজে লাগবে।
নগরীতে প্রধানত দুই কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। একটি হলো নগরীর সব কয়টি নালা ও খাল বেদখল। অপরটি দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা উল্লেখ করে মেয়র বলেন, খাল সীমানা নির্ধারণ জরিপ শেষে খাল ভরাট করে ভবন ও দোকানপাট উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করা হবে। এছাড়া নগরীর অভ্যন্তরে বিদ্যমান জলাশয়, ডোবা, নালা, পুকুর আর কেউ যেন ভরাট না নিতে পারে, এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে জনসচেতনতার বিকল্প নেই।
‘সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে এ জলাবদ্ধতা নিরসন করা সম্ভব নয়’ মন্তব্য করে মেয়র নাছির উদ্দীন বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং চীনের সরকারি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার চায়নার সঙ্গে জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে ২৭টি ম্লুইসগেট, বড় খালগুলোর দুই পাশে রিটেইনিং ওয়াল এবং খালগুলোর ড্রেজিং করার জন্য পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পটি পিডিপিপি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন হয়েছে এবং প্রকল্পটি জিটুজির মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য ইআরডিতে প্রেরণ করা হয়েছে। বর্তমানে ডিপিপি প্রস্তুতির কাজ চলছে।’
Add Comment