সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক ৫৪ জন খেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে মামলা করা হয়েছে। এসব মামলার বিপরীতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৯৭ কোটি টাকা।
যদিও করোনার কারণে এপ্রিল থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধে তিন মাসের অবকাশ পান গ্রহীতারা। পরে তা আরও তিন মাস বাড়িয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাসিক ঋণ কিস্তি পরিশোধ না করলেও খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হবেন না গ্রাহকরা। তবে করোনা সংক্রমণের কারণে এ পাওনা আদায় নিয়ে চিন্তিত অধিকাংশ ব্যাংক ব্যবস্থাপক।
এদিকে গত ১৯ মার্চ জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল, জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত কোনো গ্রাহক ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলেও তার ঋণমান অবনতি করা যাবে না। গত ১ জানুয়ারি ঋণের শ্রেণিমান যা ছিল তাই থাকবে। তবে চট্টগ্রামের এ মামলাগুলো হয়েছে ১৯ মার্চের জারিকৃত এ প্রজ্ঞাপনের আগে।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও অর্থঋণ আদালতের সূত্রে জানা যায়, পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ভোগ্যপণ্য আমদানি ও জাহাজ ভাঙা শিল্পের প্রয়োজনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে লাভবান হতে না পেরে খেলাপি হয়ে পড়েন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। এ পাওনা আদায়ে ব্যাংকগুলো চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত অর্থঋণ আদালতে মোট ৫৪টি মামলা করে। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ১১৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা আদায়ে ব্যাংকগুলো মামলা করে ১৭টি। ফেব্রুয়ারি মাসে ৪০৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা খেলাপির জন্য ২৩টি এবং মার্চ মাসে ১৭১ কোটি ৮২ লাখ টাকা আদায়ে ১৪টি মামলা হয়েছিল।
তিন মাসে খেলাপিদের বিরুদ্ধে আটটি মামলা করে পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড (ফারমার্স ব্যাংক)। সাতটি মামলা করে বিদেশি ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড। আর চারটি মামলা করে অগ্রণী ব্যাংক। ব্র্যাক ব্যাংক, উত্তরা ও যমুনা ব্যাংক তিনটি করে মামলা করে। আর মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ও আইএফআইসি ব্যাংক দুটি করে মামরা করে। এছাড়া এবি ব্যাংক, সাউথ বাংলা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, শাহজালাল, সোনালী, রূপালী, এক্সিম, ইউসিবিএল, ইসলামী ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, লংকাবাংলা, ফাস্ট ফাইন্যান্স, সিটি ব্যাংক, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স এবং কমার্স ব্যাংক প্রত্যেকে একটি করে মামলা করে।
এদিকে জানুয়ারি-মার্চ সময়ে বড় ঋণখেলাপি হিসেবে ছিল বনেদি ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী এমইবি গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এমইবি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানের কাছে এবি ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার খেলাপি পাওনা ১০৮ কোটি টাকা। এরপর পোশাক খাতের সাদ-মুসা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাদ মুসা ফেব্রিক্স লিমিটেড। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মহসিন মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটি উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধে একাধিকবার ব্যর্থ হন। ব্যাংকটির লালদীঘি শাখা গত ২৯ জানুয়ারি সাদ মুসা ফেব্রিক্স লিমিটেডের বিরুদ্ধে ৭৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে মামলা করে।
এর বাইরে পদ্মা ব্যাংকে শাহেদ শিপ ব্রেকিংয়ের বিরুদ্ধে ৫৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, এফএমএস ইস্পাত শিপ ব্রেকিংয়ের বিরুদ্ধে ৩৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা এবং ছগীর অ্যান্ড ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে ২৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা খেলাপির জন্য মামলা করে। আর ইসলামী ব্যাংকে মোবাইল জোন ২২ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংকে মিডল্যান্ড ব্যাংকের পরিচালক মুসা ইসার প্রতিষ্ঠান ১৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংকে সানোয়ারা ডেইরি ফুডস লিমিটেডের ১৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা এবং প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেডে হালদা গ্রুপের সরওয়ার আলমগীরের মালিকানাধীন এনএফ জেট অ্যান্ড টেক্সটাইলের খেলাপি ঋণ ১০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
ব্যাংকার, ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন ও আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকঋণের সুদ বেশি, ব্যবসায়িক অদক্ষতা, টানা লোকসান, ব্যাংকের দায় পরিশোধে ব্যর্থতা ও আন্তর্জাতিক বাজারে ধারাবাহিক দরপতনের কারণে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের করুণ অবস্থা। ফলে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের ব্যাংকগুলো এখন আগের মতো টাকা দিতে পারছে না। কারণ ঋণের অনাদায় বেশি চট্টগ্রামে। এজন্য বিশ্ব মন্দা ও না বুঝে বিনিয়োগ করাটা অন্যতম প্রধান কারণ। এতে বেশ কিছু শিল্প গ্রুপ ব্যবসায়িকভাবে লোকসানে পড়ে। ফলে পাওনা আদায়ের ব্যাংকগুলো মামলা করছে। তবে ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়ানো সুযোগ দিতে হবে। এখন তো ব্যাংকঋণ ৯ শতাংশ হয়েছে। আর সরকার প্রণোদনা ও বাজেটে অনেক সুযোগ দিয়েছে। এগুলোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে অবশ্যই ভালো।
এ বিষয়ে প্রথম সারির শীর্ষ একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের এক সিনিয়র কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু করোনাভাইরাসের অজুহাতে আগে থেকে দুর্বল কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি ভালো কিছু গ্রাহক নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দিয়েছে। আবার তারা প্রণোদনার জন্য দেনদরবার করছে। অর্থাৎ পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার জন্য অনেক গ্রাহক চেষ্টা করছে। এভাবে হলে তো আগামীতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। গত কয়েক বছরের কিছু ব্যবসায়ী আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় ব্যাংকের বিনিয়োগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এছাড়া পাওনা আদায়ে হেড অফিসের চাপে আছেন ব্যাংকরা।’
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের গত বছরের খেলাপি ঋণ আদায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো ৫৬৬টি মামলা করে। এছাড়া ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের দায়ে ৫৯৯টি মামলা করা হয়।