Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 11:15 pm

চট্টগ্রামে পাহাড় কাটছে নামিদামি শিল্পগ্রুপ

মোহাম্মদ আলী, চট্টগ্রাম: পাহাড় ও উপত্যকায় ঘেরা চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য প্রাচ্যের রানী হিসেবে পরিচিত। তবে আবাসন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও রাস্তাঘাট নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে চট্টগ্রামে বেআইনিভাবে পাহাড় কাটছে কয়েকটি সরকারি সংস্থা। এ কাজে পিছিয়ে নেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালীরাও। চট্টগ্রামে পাহাড় কাটছে নামিদামি শিল্পগ্রুপ।

পাহাড় কাটায় যোগ দিয়েছে ইমারত ও আবাসন নির্মাণ অনুমোদনের দায়িত্বে থাকা অভিভাবক সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (সিডিএ)। মহানগর ও জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কাটা অব্যাহত থাকলেও এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের।

অভিযোগ রয়েছে, পাহাড় কাটার শাস্তি হিসেবে জরিমানা বা ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কম হওয়ায় একই প্রতিষ্ঠান বারবার পাহাড় কাটার সাহস দেখাচ্ছে। এছাড়া পাহাড় কাটার জন্য শুনানির মাধ্যমে ধার্যকৃত জরিমানার সিংহভাগই আদায় করতে পারে না পরিবেশ অধিদপ্তর। পাহাড় কাটা রোধে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতাও।

তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে। এই সময়ে আংশিক কাটা হয়েছে ৯৫টি পাহাড়। এরপরের ১২ বছরে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্টা দিয়ে বেড়েছে পাহাড় কাটা।

‘ফৌজদারহাট-বায়েজিদ সংযোগ সড়ক’ প্রকল্পের বায়েজিদ অংশে অনুমোদনের চেয়ে বেশি পাহাড় কাটায় গত ২৯ জানুয়ারি সিডিএকে ১০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল ঢাকা পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়। আর পাহাড় কেটে জলাধার ভরাট করার অপরাধে এই প্রকল্পের ঠিকাধারী প্রতিষ্ঠান ঢাকার স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে গত বুধবার পাঁচ কোটি ২৩ লাখ টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয়।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয়ের পরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেনের প্রদত্ত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে অবৈধভাবে পাহাড় কাটার অপরাধে কয়েকটি শিল্পগ্রুপ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিকে জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম। এর মধ্যে দুটি ইস্পাত কোম্পানিকে ৯ লাখ টাকা, স্মার্ট গ্রুপকে ছয় লাখ ৪০ হাজার টাকা, নাসিরাবাদ প্রপার্টিজকে ছয় লাখ টাকা, চিটাগং বেলভিউকে সাড়ে ছয় লাখ টাকা, ফিনলে কাতালগঞ্জের এসএন গ্লোরিকে ১৪ লাখ টাকা, জঙ্গল সলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সালাউদ্দিন আজিজকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া জালালাবাদ এলাকায় পাহাড় কাটার দায়ে নাজিম উদ্দিন নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তিকে সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয় প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাহাড় কাটার অপরাধে গত ২০১১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ৯ বছরে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয় ও মহানগর কার্যালয় মোট ছয় কোটি ৮৩ লাখ ছয় হাজার ৬৩৫ টাকা জরিমানা ধার্য করে। এর মধ্যে আদায় করতে পেরেছে মাত্র দুই কোটি ৮৭ লাখ ৩৮ হাজার ৭১০ টাকা। এই ৯ বছরে জেলা পর্যায়ে চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয় ছয় কোটি ৪৫ লাখ ৫২৫ টাকা জরিমানার বিপরীতে আদায় করতে পেরেছে মাত্র দুই কোটি ৩০ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। আর ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে গত ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিন বছরে চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয় ৮২ লাখ ৬১ হাজার টাকা জরিমানার বিপরীতে আদায় করতে পেরেছে মাত্র ৫৭ লাখ দুই হাজার টাকা।

বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগরীতে আনুমানিক ৩০টি পাহাড় রয়েছে। এর মধ্যে ১০টি ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং সাতটি বিভিন্ন সরকারি সংস্থার (সিটি করপোরেশন, রেলওয়ে, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, ওয়াসা ও গণপূর্ত)। পাহাড়গুলোর সবকটিই ঝুঁকিপূর্ণ।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয়ের তথ্যানুসারে, পাহাড় কর্তন রোধে পাঁচটি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এগুলো হলোÑপরিবেশ অধিদপ্তরের পর্যাপ্ত জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আইন না মানার প্রবণতা, সচেতনতার অভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বসতবাড়ি স্থাপন ও শিল্পায়ন এবং অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট।

প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ও শিল্পগ্রুপগুলো কীভাবে পাহাড় কাটার সুযোগ পায়Ñএমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয়ের পরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেনের বরাত দিয়ে সহকারী পরিচালক নাজিম হোসেন শেখ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়, সার্বিক বিষয়, প্রভাব ও অ্যাসেসমেন্ট বিবেচনা করে। এক্ষেত্রে কাউকেই ছাড় দেওয়া হয় না।’

ধার্যকৃত ক্ষতিপূরণ আদায় করতে না পারা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অনেক ক্ষতিপূরণ অনাদায়ী রয়ে গেছে আপিলের কারণে। আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এসব ক্ষতিপূরণ আদায় হয় না। এটা চলমান প্রক্রিয়া, ক্ষতিপূরণ পেতে সময় লাগবে।’