সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামই পোশাকশিল্পের আদি ভূমি, অথচ এ শহরে দিন দিন কমছে পোশাক কারখানার সংখ্যা। করোনা মহামারিতে বন্ধ হয়েছে ৩০টি কারখানা। শুধু পোশাক কারখানা নয়, ইস্পাত কারখানা, জাহাজ ভাঙা প্রতিষ্ঠান, অক্সিজেন প্লান্ট, ভোজ্যতেল পরিশোধনাগার, কাগজ মিল, জুট মিল ও ওষুধ কারখানা বন্ধ হয়েছে। মূলত প্রতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও নেতৃত্বের অভাব, ব্যবসা বহুমুখীকরণ না করা, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি এবং ব্যবসায়িক পরিবেশ অনুকূল না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এতে উদ্যোক্তা ও ব্যাংকের বিনিয়োগের কয়েক হাজার কোটি টাকা আটকে গেছে। কাজ হারিয়েছে কয়েক লাখ শ্রমিক।
চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগ্রুপ এসএ গ্রুপ ভোজ্যতেলের বাজারে ২০১২ সালে এক নম্বর প্রতিষ্ঠান ছিল। এ গ্রুপের আওতায় দৈনিক সাড়ে তিন হাজার টন উৎপাদন সক্ষমতার দেশের বৃহত্তম ভোজ্যতেল রিফাইনারি আছে। এছাড়া পেপার মিল, লবণ, কনডেন্সড মিল্ক কারখানা, আটা, ময়দা ও সুজির কারখানা, পানিসহ আরও বেশ কয়েকটি কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে রিফাইনারি ছাড়া বাকিগুলো চালু আছে। তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফশিল করেছে। শুধু মার্জিন ঋণ সুবিধায় এলসি করতে পারলে রিফাইনারি চালু করতে আগ্রহী এ উদ্যোক্তা। অথচ এ সুবিধার অভাবে পড়েছে নারায়াণগঞ্জে দেশের সবচেয়ে বড় ভোজ্যতেলের রিফাইনারিতে।
পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন ও ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা যায়, একসময় পোশাক খাতের রপ্তানিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের কারখানাগুলোর অবদান ছিল ৩৯ শতাংশ। বর্তমানে তা মাত্র ১৫ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২১ সালের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম অঞ্চলে পোশাক খাতের নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৯৮টি। এর মধ্যে চালু আছে ৩০৯টি। চলমান করোনার মহামারিতে বন্ধ হয়েছে ৩০টি কারখানা। শুধু পোশাক কারখানা নয়, ইস্পাত কারখানা, জাহাজ ভাঙা প্রতিষ্ঠান, অক্সিজেন প্লান্ট, ভোজ্যতেল পরিশোধনাগার, কাগজ মিল, লবণ মিল, আটা, ময়দা ও সুজির মিল, জুট মিল, ওষুধ কারখানা বন্ধ হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। সবমিলিয়ে প্রায় ৬০০টির মতো বাণিজ্যিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এতে উদ্যোক্তা ও ব্যাংক বিনিয়োগের কয়েক হাজার কোটি টাকা আটকে গেছে।
অর্থনীতিবিদ, বাণিজ্য সংগঠনের নেতা ও ব্যাংকাররা জানান, কেবল চট্টগ্রাম অঞ্চলের কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের কারখানাগুলো অলস বসে আছে। এসব বন্ধ কারখানায় সরকারি-বেসরকারি অর্থায়নে কিংবা মালিকানা বদলের মাধ্যমে পুনঃঅর্থায়নে চালু হলে দেশে কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। এছাড়া জিডিপির আকার বাড়বে। এজন্য সরকারি পর্যায়ে নতুন করে পুনরুদ্ধার প্যাকেজ চালু করতে হবে। এতে শিল্পায়ন গতিশীল হবে। এসব কারখানায় পুঁজি ছাড়া বাকি সব সেটআপ রয়েছে। খেলাপি হওয়া ব্যবসায়ীদের আবারও ব্যবসায় ফিরে আসার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট-সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা ঘোষণা দিলে বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালে করোনায় গতি হারিয়ে ফেলে এ প্যাকেজ। আবার কেউ কেউ ঋণ পুনঃতফসিল করলেও পুনঃঅর্থায়ন না পেয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এ বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।
পুনঃতফসিল সুবিধা গ্রহণে আগ্রহী ব্যবসায়ীরা বলেন, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ-অযোগ্য কারণে আমরা ব্যবসায়ী বা শিল্পোদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এতে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ অনেক ক্ষেত্রেই অনিয়মিত হয়ে পড়েছিল। এতে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ও আদায় কার্যক্রম বাধাগ্রস্তও হয়েছে। এ সংকট থেকে উত্তরণ ও শিল্প-বাণিজ্য-উৎপাদনশীল খাতে স্বাভাবিক ঋণপ্রবাহ বজায় রাখাসহ ব্যাংক খাতে বিরূপভাবে খেলাপি ঋণ নিয়মিতভাবে আদায়ের লক্ষ্যে দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে সর্বোচ্চ ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিল সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। আমরাও আবেদন করি। এর মধ্যে কিছু ব্যাংকে আমরা পুনঃতফসিল করেছি। আরও কিছু আবেদন প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু নতুন করে অর্থায়ন ও নীতিগত সহায়তার ঘাটতি এবং চলমান করোনা সংক্রমণের কারণে শিল্প উৎপাদন অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এজন্য আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জারিকৃত রিআরপিডি সার্কুলার
নং-৫-এর কতিপয় শর্ত শিথিল ও প্রতিস্থাপনের জন্য অর্থমন্ত্রী বরাবর একটি আবেদন করেছি। শর্তগুলো ছিল গ্রেস পিরিয়ড এক বছর থেকে তিন বছরে উন্নীতকরণ, ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ৯ বছর থেকে ২০ বছর করা, সিআইবি নিয়মিত করা, সুদের হার কমানো এবং পুনঃতফসিলকৃত ঋণের ৫০ শতাংশ চলতি মূলধন হিসেবে নির্ধারণ।
এ বিষয়ে এসএ গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দীন আলম শেয়ার বিজকে বলেন, অনিয়ন্ত্রণযোগ্য কিছু কারণে সেই সময়ে আমরা ব্যবসায় লোকসান করি। ফলে নিয়মিত পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সার্কুলার আবারও আমাদের ব্যবসায় ফিরে আসার একটা সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে আমি ২০টি ব্যাংকে ঋণ পুনঃতফসিল করেছি। আরও কয়েকটি পুনঃতফসিল প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে।
তিনি আরও বলেন, ১০ বছর পর আমি আমার পাঁচটি কারখানায় গ্যাস সংযোগ পেয়েছি। কিন্তু এ ১০ বছর তো আমাদের অনেক কষ্ট করে ব্যবসা চালিয়ে যেতে হয়। এ সময়ে ব্যাংকের সুদ তো লাফিয়ে লাফিয়ে তিনগুণ পর্যন্ত হয়েছে। এছাড়া আমার নারায়াণগঞ্জে দেশের সবচেয়ে বড় ভোজ্যতেল রিফাইনারি চালু করতে পারছি না চলতি মূলধনের অভাবে। এ কারখানার দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা তিন হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে নতুন করে গ্যাস সংযোগ পাওয়ায় পেপারমিলে পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরু হয়েছে। একইভাবে আমার পেপার মিল, কনডেন্সড মিল্ক, বেভারেজ, লবণ, আটা, ময়দা ও ঘি কারখানা চালু আছে। সবমিলিয়ে আমাদের সুযোগ ও ইচ্ছা আছে আবার আগের মতো পুরোপুরিভাবে ব্যবসায় ফিরে আসার। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি করার সুযোগসহ নীতিগত সহযোগিতা দিতে হবে। এতে ব্যাংকের মন্দা ঋণ কমবে। তা না হলে এসব কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাকবে। লক্ষাধিক শ্রমিক-কর্মচারী বেকার বসে থাকবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে থাকবে।
এ বিষয়ে বিজিএমইএয়ের সহ-সভাপতি ও ওয়েল গ্রুপের পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, এক দশক আগে পোশাক রপ্তানিতে চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান ছিল ৪০ শতাংশ, যা বর্তমানে ১৪ শতাংশে নেমে এসেছে। মূলত চট্টগ্রামের গ্যাস সংকট, বিদ্যুৎ সংকট, জমি সংকট, ব্যাংকসহ অবকাঠামোগত বিভিন্ন সমস্যার কারণে পোশাক খাতে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েক বছরের চট্টগ্রাম অঝ্চলের ৩৮৯টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের কার্যক্রম সহজীকরণ করতে হবে।