Print Date & Time : 26 June 2025 Thursday 12:11 am

চট্টগ্রামে সরকারি নির্দেশনা মানছেন না বেসরকারি হাসপাতাল মালিকরা!

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: প্রতিনিয়ত নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি হৃদরোগ, বার্ধক্যজনিত রোগসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। এ বিপুল পরিমাণ কভিড ও নন-কভিড রোগীকে সরকারি হাসপাতালগুলোয় প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

অথচ এ সংকট চলাকালে সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে রোগীকে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানে নানা অজুহাতে বিরত আছে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালগুলো। এসব হাসপাতালে ৫০টির অধিক আইসিইউ বেড ও ভেন্টিলেটর সুবিধা আছে। এতে সাধারণ নাগরিকের বাড়ছে দুর্ভোগ ও ভোগান্তি। আর অনেকটা উদাসীন প্রশাসন ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো।

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সর্বশেষ দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা শুরু হয় ২৫ মার্চ। আর প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় এর ঠিক ১০ দিন পর ৩ এপ্রিল। আর এ পর্যন্ত চট্টগ্রামে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা দুই হাজার ৫৮৩ জন, আর মারা গেছেন ৭১ জন। এদিকে চট্টগ্রামে সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত করোনা চিকিৎসার জন্য বেড আছে ৩১৫টি।

এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ১০০ সিটের আইসোলেশন ও ১০ সিটের আইসিইউ বেড, ফৌজদারহাটের বিশেষায়িত হাসপাতাল বিআইটিআইডিতে ৩০ সিটের আইসোলেশন বেড, একই এলাকায় ফিল্ড হাসপাতালে ৫০ সিট ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩০ সিটের অবজারভেশন বেড রয়েছে। এসব বেড আপাতত করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।

এছাড়া ১৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ১৪টি ও বেসরকারিভাবে ১০ অ্যাম্বুলেন্স মিলে মোট ২৪টি অ্যাম্বুলেন্স জরুরি সেবা প্রদানের জন্য প্রস্তুত আছে। অপরদিকে গত ৪ এপ্রিল এক সমন্বয় সভায় করোনা-আক্রান্ত রোগী বাড়লে চিকিৎসার জন্য ১২টি হাসপাতালের তালিকা করেছিলেন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক। বর্তমানে রোগী বাড়লেও সেগুলো অধিগ্রহণ করা হয়নি। এজন্য ওই হাসপাতালগুলো সেবা দিচ্ছে না।

অথচ চট্টগ্রাম মহানগরে ৭০টির মতো ছোট-বড় বেসরকারি হাসপাতাল আছে। আর এসব হাসপাতালে সংকটাপন্ন রোগীর প্রয়োজনীয় ৫০টির অধিক আইসিইউ বেড ও ভেন্টিলেটর সুবিধা আছে, যদিও তারা সরকারি নির্দেশনা মানছে না। এর জন্য কোনো ধরনের ব্যবস্থাও নিচ্ছে না স্বাস্থ্য বিভাগ।

মূলত চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়হীনতার কারণে এমনটা হচ্ছে। আক্রান্তের তুলনায় চিকিৎসা বেড কম হওয়ায় দৃশ্যমান উপসর্গ না থাকলে রোগীকে বাড়িতে আইসোলেশনে রাখা হচ্ছে। আর হাসপাতালগুলোয় আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছে ২১৯ জন।

সিভিল সার্জন ও বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল রাতে কভিড-১৯ আক্রান্ত মায়ের ডায়ালাইসিসসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা না পেয়ে ঢাকায় রওনা হন চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক হাসান শাহরিয়ার কবির। তার পক্ষে জেলা সিভিল সার্জন শেখ ফজলে রাব্বী মেট্রোপলিটন, ম্যাক্স, পার্কভিউ, সিএসসিআরসহ বেশ কয়েকটি হাসপাতালে যোগাযোগ করলেও কেউ সেবা দিতে রাজি হননি। ফলে তিনি ঢাকা আনোয়ার খান মডার্ন হসপিটালে মাকে ভর্তি করান।

এদিকে গত ১৩ মে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিতে তিনটি নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এই তিন নির্দেশনা হচ্ছে-সব বেসরকারি হাসপাতাল/ ক্লিনিকগুলোয় সন্দেহভাজন কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকতে হবে। জরুরি চিকিৎসার জন্য আগত কোনো রোগীকে ফেরত দেওয়া যাবে না।

রেফার করতে হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘কোভিড হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ কক্ষ’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে রোগীর চিকিৎসার বিষয়টি সুনিশ্চিত করে রেফার করতে হবে এবং দীর্ঘদিন ধরে যেসব রোগী কিডনি ডায়ালাইসিসসহ বিভিন্ন চিকিৎসা গ্রহণ করছেন, তারা কোভিড-আক্রান্ত না হয়ে থাকলে তাদের চিকিৎসা অব্যাহত রাখতে হবে।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, এসব নির্দেশনা অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রচলিত বিধান অনুসারে লাইসেন্স বাতিলসহ প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা-১ শাখার উপসচিব মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, সরকারিভাবে নির্দেশনা থাকলেও আমরা করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকা রোগী ভর্তি নিতে পারছি না। এ ধরনের রোগী ভর্তি করা হলে অন্যদের মধ্যে আতঙ্ক কিংবা সংক্রমণ হতে পারে। এর দায় কে নেবে? আর অন্য রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য হাসপাতাল চালু তো রেখেছি।

আপনারা জানেন, করোনা রোগী শনাক্তের পর চট্টগ্রামের কয়েকটি হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ডাক্তার ও নার্সদের কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। এতে সাধারণ রোগীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। তাই নির্দিষ্ট গাইডলাইন না পেলে আমরা করোনাভাইরাসের রোগী ভর্তি করাব না।

বেসরকারি চিকিৎসাসেবা দিতে কেন এত অপারগতা-এ ব্যাপারে জানতে বেশ কয়েকবার বেসরকারি হাসপাতাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও মম্যাক্স হসপিটাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাক্তার লিয়াকত আলীর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোস্তফা খালেদ আহমদ শেয়ার বিজকে বলেন, চট্টগ্রামে বেসরকারি হাসপাতালগুলো এখন পর্যন্ত করোনা চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করেনি, যদিও এ বিষয়ে আজ সার্কিট হাউসে একটি মিটিং হয়েছে। তবে এখনও রেজুলেশন হয়নি। তাই এ মুহূর্তে কিছু বলা যাচ্ছে না। এটা বলতে পারি বেসরকারি হাসপাতাল মালিকরা একটি হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসার জন্য দ্রুত প্রস্তুত করবেন।

৪ এপ্রিলের এক মিটিংয়ে ১২টি বেসরকারি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আজকে মিটিং হয়েছে। তারা একটি হাসপাতালকে ডেডিকেটেড কভিড হাসপাতাল হিসেবে রেডি করে দেবেন। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে সময়ক্ষেপণ কিংবা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, অথবা করোনা চিকিৎসায় সরকারিভাবে আরও বেড বাড়ানো হবে কি না-জানতে চাইলে তিনি বিষয়টিগুলো এড়িয়ে যান।

এদিকে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার আগে সরকারি নির্দেশনা মেনে চট্টগ্রামে রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে বেসরকারি হাসপাতাল মালিকদের হুশিয়ার করেছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ও চট্টগ্রামের কোতোয়ালি আসনের সংসদ সদস্য মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।

গত শুক্রবার (২৯ মে) রাত ৮টায় নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক টাইমলাইনে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে চট্টগ্রামে করোনা পরিস্থিতিতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ‘মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার আগে’ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে বেসরকারি হাসপাতাল মালিকদের প্রতি এই হুশিয়ারি দেন। তিনি বলেন, রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে হাসপাতাল মালিকদের হঠকারিতার বিষয়ে ক্ষোভে ফুঁসছে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ।