নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম শহরে প্রতিদিন যাত্রীদের যাতায়াত (ট্রিপ) হয় ৫৬ লাখ। আর নগরের প্রতিষ্ঠিত রুটগুলোর মধ্যে ৪৯ শতাংশ বাস, হিউম্যান হলার বা টেম্পো চলাচল করে। এসব গণপরিবহন নগরের ৭১ শতাংশ যাত্রী ব্যবহার করে। আর ২৩ শতাংশ যাত্রী হেঁটে গন্তব্যে যায় ও বাকি ছয় শতাংশ যাত্রী নিজস্ব ছোট পরিবহনে চলাচল করে। গতকাল নগরীর র্যাডিসন ব্লু বে চিটাগং হোটেলে অনুষ্ঠিত ‘চিটাগং স্ট্র্যাটেজিক আরবান ট্রান্সপোর্ট মাস্টারপ্ল্যান’ শীর্ষক এক কর্মশালায় এমন তথ্য উপস্থাপন করে বিশ্ব ব্যাংক পরিচালিত পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন।
এতে বলা হয়, ১৭ শতাংশ জনগোষ্ঠীর নিজস্ব পরিবহন আছে। অর্থাৎ ৮৩ শতাংশ মানুষ ব্যক্তিগত যান ব্যবহার করতে পারে না। তবে ২২ শতাংশ যাত্রী প্রয়োজনে ভাড়া করা সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা রিকশা ব্যবহার করে।
‘চিটাগং স্ট্র্যাটেজিক আরবান ট্রান্সপোর্ট মাস্টারপ্ল্যান’ শীর্ষক এক কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপূর্ত ও গৃহায়ণমন্ত্রী প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম। আরও উপস্থিত ছিলেন সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনি, প্রকল্প সমন্বয়ক নগরবিদ শাহিনুল ইসলাম খান, বিশ্বব্যাংক টিম লিডার সিজুওকি সাকাকি এবং ডেভিট ইনহামসহ বিভিন্ন অংশীজন প্রতিনিধি।
গণপূর্ত ও গৃহায়ণমন্ত্রী প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম শহরকে পরিকল্পিত শহরে গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, চসিক ও চউক একসঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এক্ষেত্রে কারও সঙ্গে কারও সমন্বয় নেই। আমি পাঁচলাইশে গণপূর্ত বিভাগের জমিতে স্থাপিত পার্কের উন্নয়নে ১৫ কোটি টাকার প্রজেক্ট নিতে গেলে তখন মেয়র নাছির চসিকের জমি দাবি করে মামলা করে বসে। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম শহরের চারদিকে ময়লা-আবর্জনায় ভরা। পুরো শহরজুডে গন্ধ। তাহলে সিটি করপোরেশন কী করে?
নগরের যানজট নিরসনে সিডিএর সহযোগিতায় বিশ্বব্যাংক নগরের কৌশলগত পরিবহন মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। এ লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক টিম মহাপরিকল্পনা নিয়ে জরিপ কার্যক্রম শেষ করে। এ পর্যবেক্ষণে বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরের রাস্তায় চলাচল করা গাড়ির মধ্যে ৫৬ শতাংশই ছোট আকৃতির (রিকশা, অটোরিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়ি) পরিবহন। এসব গাড়ি যাত্রী পরিবহন করে মাত্র ১১ শতাংশ। আর তাদের খেয়াল-খুশিমতো পরিবহনের কারণে নগরের দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। আর ৭৫ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করে বাস-মিনিবাস তথা গণপরিবহন। অথচ মোট গাড়ির মাত্র আট শতাংশ গণপরিবহন।
গবেষকদল বলেন, বর্তমানে পুরো নগরীই দিনের যেকোনো সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকা থাকে। আর এসব যানজটের কারণ চালকদের ট্রাফিক আইন না মানা, যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠা নামা করা, স্কুলগুলোর নিজস্ব বাস সার্ভিস না থাকা, পর্যাপ্ত ফুটপাত না থাকা, ফুটপাত হকারের দখলে থাকা, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেনগুলোর পার্কিংয়ের স্থান না থাকা, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম না থাকা, ট্রাফিক পুলিশের জনবল সংকট, ট্রাফিক বিভাগের স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল না থাকা, মার্কেটগুলোয় গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা না থাকা, সড়কে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন চলাচল এবং সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি আর খানাখন্দ সড়ক। ফলে দিনের অধিকাংশ সময় যানজটের যান ও মানুষ ভোগান্তিতে পড়ে বিমানবন্দর সড়কের সল্টগোলা ক্রসিং, বারিক বিল্ডিং মোড়, আগ্রাবাদের বাদামতলী ও চৌমুহনী মোড়, জিইসির মোড়, জাকির হোসেন সড়ক, মুরাদপুর মোড়, বহদ্দারহাট মোড়, অক্সিজেন মোড়, কর্ণফুলী সেতু মোড়, চকবাজার কাঁচাবাজর মোড়, আন্দরকিল্লা মোড়, অক্সিজেন মোড়, বহদ্দারহাট মোড় ইত্যাদি।
পরামর্শ আলাপে সড়ক ও নগর বিশেষজ্ঞ বলেন, বিশ্বব্যাপী নগর পরিবহন ব্যবস্থা নিবিড়ভাবে চলার জন্য প্রধান সড়কগুলোয় ছয় ধরনের সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়। এগুলো হচ্ছে বাস বে (বাস থামার জন্য রাস্তার পাশে অতিরিক্ত স্থান), নির্দিষ্ট স্থানে বাস স্টপ থাকা, পর্যাপ্ত পরিমাণ ফুটপাত থাকা, স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সংকেত বাতি, যথাযথ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ও সড়কবাতি থাকা। কিন্তু চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রধান সড়কগুলোয় ছয় ধরনের সুযোগ-সুবিধা না থাকায় প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ ও ভোগান্তিতে পড়ছে নগরবাসী। আর ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমানো না গেলে যানজট ভবিষ্যতে আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে। এখন থেকেই এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হওয়া দরকার।
বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞ শিগে সাকাকি বলেন, নগরের পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে জরিপ কার্যক্রম চলছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেওয়া হবে। এর ওপর ভিত্তি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে যানজট সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে।