সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের প্রধান গেটওয়ে চট্টগ্রাম বন্দর। এ বন্দর দিয়ে প্রতিবছর বাড়ছে আমদানিকৃত পণ্যবাহী জাহাজ, কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং। কিন্তু সেই হারে বাড়েনি বন্দরের সক্ষমতা। তবে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে স্বল্পমেয়াদি আটটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে। যদিও এসব প্রকল্পের মধ্যে মাত্র একটির অগ্রগতি ৫০ শতাংশ। অন্যগুলোর অগ্রগতি ৩৫ শতাংশের কম। আর মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়ন এখনও শুরু হয়নি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) সূত্রে জানা যায়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত আটটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে তিন হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা। যদিও গত অক্টোবর পর্যন্ত এসব প্রকল্পের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭৬৭ কোটি টাকা। আর্থিক হিসাবে অগ্রগতি ২২ শতাংশেরও কম।
তথ্যমতে, ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ১নং জেটির উজানে একটি সার্ভিস জেটি নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এরপর কর্ণফুলী নদীর নাব্য ফেরাতে প্রায় ২৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন সদরঘাট টু বাকলিয়ার চর ড্রেজিং; এক হাজার ৮৬৮ কোটি টাকায় পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ; ১২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাগবোট সংগ্রহ; ৯৪ কোটি টাকায় দুটি মোবাইল হারবার ক্রেন সংগ্রহ; ১৯২ কোটি ব্যয়ে দুটি কাটার সাকশন ড্রেজার, সহায়ক বোট ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহ; ৮৭ কোটি টাকায় নিউমুরিং দ্বিতীয় ওভারফ্লো কনটেইনার ইয়ার্ড নির্মাণ এবং নেদারল্যান্ডস সরকারের অর্থায়নে প্রায় ৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ট্রেনিং ইনস্টিটিউট নির্মাণ।
আট প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পে। অক্টোবর পর্যন্ত এ প্রকল্পে ৫০ শতাংশ কাজ হয়েছে। এতে সংস্থাটির ব্যয় হয়েছে ৬৯৭ কোটি টাকা। প্রকল্পের মোট ব্যয় এক হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। আর সবচেয়ে কম অগ্রগতি হয়েছে ৯৪ কোটি টাকায় দুটি মোবাইল হারবার ক্রেন সংগ্রহ প্রকল্পে। এ প্রকল্পের অগ্রগতি এক শতাংশের কম। আর দুটি প্রকল্পের কাজই শুরু হয়নি। এদিকে ড্রেজিং না হওয়ার কারণে সদরঘাট এলাকার লাইটারেজ জেটির ব্যবহার শুরু করতে পারেনি বড় বড় শিল্প গ্রুপগুলো।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের ১নং জেটির উজানে একটি সার্ভিস জেটি নির্মাণ প্রকল্প শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। অথচ গত সাড়ে চার বছরের এ প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৩৯ শতাংশ। এখন পর্যন্ত এ খাতে ব্যয় হয়েছে মাত্র ১৯ কোটি টাকা।
প্রকল্পের ধীরগতি সম্পর্ক জানতে চাইলে চবকের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান সরকার শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ঠিকাদার নিয়োগশেষে কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে। প্রকল্পের ডিপিপি অনুযায়ী সময় দেখানো হয়েছে ২০২০ সাল। তবে ঠিকাদার নিয়োগ করে কার্যাদেশ দিতে হয়েছে, চুক্তি করতে হয়েছে। তারপর প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্পের কাজ কিন্তু অনেক পরে শুরু হয়েছে। কিছু প্রতিবন্ধকতা ছিল, তবে তা ওভারকাম হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। গত নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের ৩৫ শতাংশ বাস্তব (ভৌত) অগ্রগতি হয়েছে।’
এদিকে ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ার চর ড্রেজিং’ প্রকল্পের কাজ মাঝপথে এসে বন্ধ হয়ে যায়। গত অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পের খননকাজের ৩১ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছিল। কিন্তু গত তিন মাস সাকশন ড্রেজার বন্ধ থাকায় নদীর তলদেশে খননকৃত অংশে ফের পলি জমে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলেন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে প্রায় ২০ ফুট গভীর পর্যন্ত জমেছে পলিথিনের স্তর, যা খনন করতে গিয়ে একটি কাটার মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। অপর দুটি মেশিন দিয়েও খননকাজ করা যাচ্ছে না। ফলে নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। পলি জমে ভরাট হওয়া কর্ণফুলী নদী খননের জন্য চীন থেকে আনা হয়েছিল ৩১ ইঞ্চি ব্যাসের সাকশন ড্রেজার। তবে বারবার ড্রেজারটি আটকে যাচ্ছিল নদীর তলদেশে জমা পলিথিন ও বর্জ্য।ে প্রত্যাশিত কাজ চালাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত বন্ধ করতে হয়েছে ড্রেজারটির খনন কার্যক্রম। গত কয়েক মাস ধরে অলস ভাসছে ড্রেজারটি। ফলে কর্ণফুলী ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী ও ভোগ্যপণ্যের বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘নির্দিষ্ট সময়ে বন্দর আমাদের লাইটারেজ জেটি বুঝিয়ে দিতে পারেনি। ড্রেজিংয়ের কারণে দেরি হচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ বলেছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে করে দেবে। আর এটি চালু হলে পণ্য খালাসে আরও ভালো সুবিধা পাব।’
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী ফোরোমের সভাপতি ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, দেশের অর্থনীতির জন্য চট্টগ্রাম বন্দর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। এজন্য বন্দরের চলমান প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে। এমনি ব্যবসায়ীরা অনেক চাপে আছেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এসব প্রকল্প শেষ হলে ব্যবসায়ীরা ভোগান্তি কমবে।