সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি কাজ শেষ হয়েছে। আর আগামী জুলাইয়ে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল চালু হতে যাচ্ছে। এটি চালু হলে দীর্ঘ ১৪ বছর পর নতুন টার্মিনাল পাবে চট্টগ্রাম বন্দর। এ টার্মিনালে একসঙ্গে তিনটি কনটেইনার জাহাজ থেকে বছরে সাড়ে চার লাখ কনটেইনার ওঠানো-নামানো যাবে। পাশাপাশি ডলফিন জেটিতে তেলবাহী জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করা যাবে। এতে বন্দর ব্যবহারকারীরা নিজেদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম দ্রুত ও কম খরচে সম্পন্ন করতে পারবেন; বন্দরের রাজস্ব আয়ও বাড়বে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশেরও বেশি চট্টগ্রাম বন্দরের অধীনে হ্যান্ডলিং হয়। যদিও এ বন্দরে বর্তমানে জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি), চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) ও নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) নামের তিনটি টার্মিনালে মোট ১৯টি জেটি রয়েছে। এসব টার্মিনালে বর্তমানে কার্যক্ষমতার অতিরিক্ত কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে। ফলে বন্দর পরিচালনায় নতুন একাধিক টার্মিনালের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এর অংশ হিসেবে ২০১৭ সালের ১৩ জুন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থে বাস্তবায়নাধীন পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল শীর্ষক প্রকল্পটি এক হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে অনুমোদিত হয়। আর বাস্তবায়নে সময়সীমা নির্ধারিত ছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরের পক্ষ থেকে প্রাক্কলিত ব্যয় এক হাজার ৩৯৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা এবং প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করে আরডিপিপি পাঠানো হয়। এর মধ্যে কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম পাড়ে চট্টগ্রাম ড্রাইডক থেকে বোটক্লাব পর্যন্ত ৩২ একর এলাকাজুড়ে নির্মিত হয়েছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি)।
এ প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে ৬০০ মিটার দীর্ঘ তিনটি জেটি। থাকছে ২২০ মিটার দীর্ঘ একটি ডলফিন জেটিও। আর সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের পানির নিচের অংশের দৈর্ঘ্য) এবং ১৯০ মিটার জাহাজ ভেড়ানো যাবে এই টার্মিনালে। ফলে একসঙ্গে তিনটি জেটিতে তিনটি জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর সুবিধা থাকবে। পাশাপাশি তেলবাহী জাহাজ থেকে তেল খালাস করা যাবে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের বার্ষিক সক্ষমতা বাড়বে সাড়ে চার লাখ টিইইউএস (টোয়েন্টি ফিট ইকুইভিলেন্ট ইউনিটস)। আর এক লাখ ১২ হাজার বর্গমিটার অভ্যন্তরীণ ইয়ার্ডের পাশাপাশি ১৬ একর আয়তনের একটি কনটেইনার ইয়ার্ডটিকে পিসিটির জন্য ডেডিকেটেড করা হচ্ছে, যেখানে একসঙ্গে সাড়ে চার লাখ টিইইউএস (টোয়েন্টি ফিট ইকুইভিলেন্ট ইউনিটস) কনটেইনার রাখা যাবে। আর পিসিটি নির্মাণ বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী। শতভাগ কাজ শেষে তারা চট্টগ্রাম বন্দরকে টার্মিনালটি বুঝিয়ে দেবে।
আরও জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) পদ্ধতিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আওতাধীন প্রকল্পটির জন্য আন্তর্জাতিক মানের বেসরকারি অপারেটর নিয়োগের উদ্দেশ্যে ‘ইকুইপ, অপারেট অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স অব পিসিটি অন পিপিপি মডেল’ শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার, যার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। বছর দুয়েক আগে টার্মিনাল অপারেশন পরিচালনা ও বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয় সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল, দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড, ভারতের আদানি পোর্ট অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড ও সিঙ্গাপুরের পিএসএ। তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। ফলে পিপিপির ভিত্তিতে এ প্রকল্প চালু করার কথা থাকলেও দেশের প্রয়োজনে আগামী জুলাই মাস থেকেই টার্মিনালের অপারেশন চালু করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, যা পরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেয়া হবে। তারা ই-যন্ত্রপাতি সংযোজন করবে।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারীরা বলেন, দেশের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের বন্দর সক্ষমতা আরও ১০ বছর আগে বাড়ানো দরকার ছিল। সেই জায়গায় ১৪ বছর পর নতুন টার্মিনাল চালু হতে যাচ্ছে। আর বে-টার্মিনাল প্রকল্পের কথা শুনছি গত ১০ বছর ধরে। অথচ এখন পর্যন্ত কাজই শুরু হয়নি। আমাদের দ্রুত সময়ে গভীর সমুদ্রবন্দর চালু করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এতে আমাদের সম্ভাবনা ও সক্ষমতা বাড়বে। তা না হলে আমাদের পোর্ট টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম আরও বাড়বে। এমনিতে আমাদের পোর্টে সময় বেশি লাগে। বন্দরের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যদি সক্ষমতা বাড়ানো হতো, তাহলে আজ এ পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, আগামী জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল চালু হবে। বন্দরের নিজস্ব অর্থায়ানে এক হাজার ২২৯ কোটি টাকায় টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে। আর চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব সক্ষমতা দিয়েই নতুন এ টার্মিনাল চালু করা হচ্ছে। এটি চালু হলে বন্দরে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর জেটির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১৬টিতে। ফলে বহির্নোঙরে জাহাজের অপেক্ষাকাল কমে আসবে। এতে বন্দর ব্যবহারকারীদের ব্যয় ও সময় সাশ্রয় হবে। ফলে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় ব্যবসায়ীরা এগিয়ে যাবেন।