নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ঘোষণায় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১২টি কনটেইনারে আমদানি নিষিদ্ধ সিগারেট, এলইডি মনিটর ও দামি ব্র্যান্ডের মদের বিশাল চালান জব্দ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর। এতে ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা উদ্ঘাটন হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। জব্দকৃত কনটেইনারগুলোর কায়িক পরীক্ষা শেষে গতকাল এ তথ্য জানানো হয় শুল্ক গোয়েন্দার পক্ষ থেকে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি গেটে গতকাল সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত অপর ছয়টি কনটেইনারের কায়িক পরীক্ষা করা হয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, কন্টেইনারগুলোর মধ্যে সনি ব্র্যান্ডের ৩২, ৪০, ৪৯, ৫০, ৫৫ ও ৬৫ ইঞ্চির এলইডি টিভি রয়েছে। আরও রয়েছে ইজি ব্র্যান্ডের সিগারেট। এছাড়া বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ পাওয়া গেছে। গত দুদিনে এসব কন্টেইনারে থাকা সিগারেট, মদ ও টিভির শতভাগ কায়িক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। ফলে পণ্যের পরিমাণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি শুল্ক কর্মকর্তারা। তবে রাতের মধ্যেই শতভাগ কায়িক পরীক্ষা সম্ভব বলে তারা জানিয়েছেন। এ সময় শুল্ক গোয়েন্দা, কাস্টমস, বন্দর, সিঅ্যান্ডএফ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য আমদানির মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকির বিষয়টি নজরে আসে। একই মালিকানাধীন আরেক প্রতিষ্ঠানের আরও ছয় কন্টেইনারের কায়িক পরীক্ষা গত রোববার করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা মূল্যের সিগারেট ও এলইডি টিভি আমদানি করেছে ঢাকার প্রতিষ্ঠান ‘হেনান আনহুই এগ্রো’। প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে দাখিল করা নথিতে ২৫ লাখ টাকা মূল্যের ছয় কন্টেইনার মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঘোষণা দিয়েছিল। ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য আমদানির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি সরকারের প্রায় ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। গত দুদিন চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি গেটের কায়িক পরীক্ষার পর বিষয়টি নিশ্চিত করেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা। প্রাথমিক তদন্তে প্রতিষ্ঠানটির মালিকের নাম খোরশেদ আলম বলে জানা গেছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানায় গিয়ে তাকে পাননি গোয়েন্দারা। কারখানাটিতে যন্ত্রপাতি স্থাপনের মতো সক্ষমতাও নেই। গোয়েন্দাদের ধারণা, প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতির নাম দিয়ে একটি শক্তিশালী চক্রের সহায়তায় এসব জালিয়াতির চেষ্টা করা হয়। একই মালিকানাধীন এগ্রো বিডি লিমিটেড নামে কেরানীগঞ্জের আরেক প্রতিষ্ঠানের নামে আনা আরও ছয়টি কন্টেইনার নজরদারিতে রাখা হয়েছিল, গতকাল এসব কন্টেইনারের কায়িক পরীক্ষা করা হয়। এর আগেও এ দুই প্রতিষ্ঠানের নামে ৭১টি কন্টেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস হয়েছে। এসব চালানেও ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য এসেছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। বিস্তারিত খতিয়ে দেখতে শুল্ক গোয়েন্দার একটি টিম মাঠে কাজ করছে। একই প্রতিষ্ঠানের নামে গত আট মাসে ৭১টি কন্টেইনার খালাস হয়েছে বলেও জানিয়েছেন শুল্ক কর্মকর্তারা।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ৬০০ শতাংশ শুল্কযুক্ত সিগারেট ও প্রায় ১২০-৩০০ শতাংশ শুল্কযুক্ত এলইডি টিভি আমদানি করে। প্রাথমিক পরীক্ষায় এসব কন্টেইনারে ইজি ব্র্যান্ডের সিগারেট এবং সনি ও স্যামসাং ব্র্যান্ডের বিভিন্ন ধরনের এলইডি টিভি পাওয়া গেছে।
উপস্থিত কর্মকর্তারা অনুমানের ভিত্তিতে বলেন, এসব পণ্যের বাজারমূল্য ১৫০ কোটি টাকারও বেশি। এসব পণ্য আমদানির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি সরকারের প্রায় ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। তবে পুরোপুরি নিরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এসব পণ্যের বাজারমূল্য ও ফাঁকি দেওয়া রাজস্বের পরিমাণ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।
শুল্ক গোয়েন্দা ও কাস্টমসের সূত্রমতে, গত সপ্তাহে ১২টি কন্টেইনার নজরদারিতে আনে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। এমভি ভাসি সান ও এমভি সিনার সুভাং জাহাজে করে এসব কন্টেইনার ১ ও ৩ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। নজরদারির বিষয়টি অনুমান করে আমদানিকারক ও খালাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এসব পণ্য ফেরত পাঠাতে বন্দর ও কাস্টমসে চিঠি (আরওবি) দেওয়া হয়। হেনান আনহুই এগ্রো নামের প্রতিষ্ঠানটির আমদানি করা এসব কন্টেইনারে চীনের ‘জাম রাজ ইন্ডাস্ট্রিজ’ থেকে কেনা ২৫ লাখ ৭ হাজার টাকার মূলধনি যন্ত্রপাতি রয়েছে বলে জানানো হয়। আমদানিকারকের পক্ষে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আগামপত্র (বিল অব এন্ট্রি: ২৯১৪২১) দাখিল করে চালানটির খালাসে দায়িত্বপ্রাপ্ত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ‘রাবেয়া অ্যান্ড সন্স’।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট রাবেয়া অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী মো. জালাল উদ্দিনের সন্ধানে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে সাত্তার চেম্বারের চতুর্থ তলায় গিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ পাওয়া যায়। দুদিন ধরে অফিসে তালা ঝুলছে বলে জানিয়েছেন ভবনের অন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার এএফএম আবদুল্লাহ খান বলেন, বড় একটি জালিয়াতচক্র এই চোরাচালানের চেষ্টা করেছে বলেই ধারণা করছি। এ ধরনের জালিয়াতি করায় সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। ১২টি কন্টেইনারে প্রায় ১০০ কোটি টাকার পণ্য আছে বলে আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছিলাম। একটি কন্টেইনারের সব পণ্য গণনার পর এখন মনে হচ্ছে জব্দ করা পণ্যের বাজারমূল্য আরও বেশি হতে পারে।
Add Comment