বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য বিরল প্রজাতির গাছ-গাছালি আর জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজের হাতছানি। পাহাড়ের ওপর ফুল, ফল আর কাঠ জাতীয় গাছের শোভা ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট এবং উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাম্পাসে পাহাড় ও পাহাড়ি বন আছে ২৫০ একর জায়গায়। ৬০০ একরজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে সৃজিত বন। ১৫০ একর ভূমির মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদ উদ্যান। লেক রয়েছে ২৫টি। বড় পুকুর রয়েছে ৫টি। সবুজ পাহাড়ের বুকে ঝরনা ও ছড়া তো রয়েছেই।
প্রাণীবিদদের ভাষ্যমতে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ৩০৮ প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ব্যাঙ ১৭ প্রজাতির, সরীসৃপ ৫৬ প্রজাতির, স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে ২০ প্রজাতির। চবি ক্যাম্পাসে ২১৫ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এর মধ্যে ১০৮টি গায়ক এবং ১০৭টি অগায়ক পাখি রয়েছে। ২১৫ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৬০টি প্রজাতির স্থায়ী নিবাস ক্যাম্পাসেই। ৫১টি অতিথি পাখি হিসেবে বিভিন্ন মৌসুমে ক্যাম্পাসে বিচরণ করে, আবার চলে যায়। বাকি চারটি প্রজাতির পাখি মাঝে মধ্যে ক্যাম্পাসে আসে। বিরল প্রজাতির গিরগিটি, বন্যশূকর, বাগডাসা, শিয়াল, সজারু কাঠবিড়ালি, অজগর, গুইসাপ রয়েছে এই ক্যাম্পাসে। মৌমাছি ও বোলতাজাতীয় পতঙ্গ রয়েছে ৪৪০ প্রজাতির। এছাড়া রয়েছে ৩৬৮ প্রজাতির উপকারী ও অপকারী কীটপতঙ্গ।
২ হাজার ১০০ একরের বিশাল এই ক্যাম্পাস জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিক গাছপালা ও তৎসংলগ্ন ঝোপ-ঝাড় বন্যপ্রাণীদের প্রাকৃতিক অভয়াশ্রমের কাজ করে। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ আর অবহেলার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে পশু-পাখি, উদ্ভিদ ও প্রাণী। পাহাড়ে আগুন, বহিরাগতের দৌরাত্ম্য, রাস্তা সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ব্যাপকহারে বৃক্ষনিধন ও নিরাপত্তার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে চবি ক্যাম্পাসের জীববৈচিত্র্য। ফাঁদ পেতে হরিণ শিকারের কারণে বর্তমানে মায়া হরিণের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে।
দিনদিন ক্যাম্পাসের জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ছে। অরক্ষিত সীমানার কারণে বহিরাগতদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। প্রায়ই কাটা হচ্ছে গাছ। এমনকি এসব গাছ পরিবহনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের রুটকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিবিসি সায়েন্স ফোকাস ম্যাগাজিন অনুযায়ী, একজন মানুষ বছরে ৯ দশমিক ৫ টন বাতাস শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে। বছরে অন্তত ৭-৮টি গাছ এ পরিমাণ অক্সিজেন বাতাসে ছড়াতে পারে। উদ্ভিদবিষয়ক সাইট ফ্যান্থমফরেস্ট ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, একটি পূর্ণাঙ্গ গাছ অন্তত ১৮ জন মানুষের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারে। আর ডে ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, একটি গাছ দূষিত বাতাস থেকে বছরে ৪৮ পাউন্ড কার্বন-ডাই অক্সাইড শুষে নেয়। ঘন ঘন পাহাড়ে আগুন লাগার কারণে পুড়ছে সবুজ পাহাড়। পশুপাখির হারাচ্ছে তাদের আশ্রয় ও আবাসস্থল। খাবার আর নিরাপদ আশ্রয়ের খুঁজে তারা মাঝে মধ্যেই পাহাড় থেকে নেমে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে পুরো ক্যাম্পাস সুরক্ষিত রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে যেসব প্রাণী এখনও ঠিকে আছে তা চিরতরে হারিয়ে যাবে। তাছাড়া পাহাড়ের গহিন জঙ্গলে ঢুকে কাঠ সংগ্রহ কিংবা পাতা
কুড়ানো বন্ধ করতে হবে। কেননা এতে প্রাণীদের স্বাভাবিক চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে।
ক্যাম্পাসের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে পাহাড়ে আগুন লাগানো ও পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। ক্যাম্পাসে কিছু প্রজাতির গাছ বেশি আবার কিছু প্রজাতির গাছ খুবই কম রয়েছে। ফলে প্রাণীরা কিছু ঋতুতে বেশি খাবার পায় আবার কিছু ঋতুতে কম খাবার পায়। এখানে প্রাণীদের খাবারের ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনয়ন করা প্রয়োজন। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, মেহগনিসহ কোনো প্রকার বিদেশি গাছ রোপণ করা যাবে না। প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষার জন্য পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। এর পাশাপাশি ব্যাপক জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। ক্যাম্পাসের বন্যপ্রাণীর সুরক্ষার জন্য বননিধন বন্ধ করতে হবে। ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষায় ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
আশরাফুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়