প্রতিনিধি, রংপুর: রংপুরে প্রতি বছর জুনের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বাজারে পাওয়া যায় স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় আঁশহীন সুমিষ্ট হাঁড়িভাঙা আম। তবে এবার আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারজাত করার আগেই রংপুরের বিভিন্ন বাজারে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত এই আমের বিক্রি শুরু হয়েছে। দাম কিছুটা চড়া হলেও হাঁড়িভাঙার স্বাদ নিতে ভিড় বেড়েছে হাট-বাজারগুলোয়। এই আম ঘিরে চাষি ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন।
বর্তমানে আকারভেদে প্রতি মণ হাঁড়িভাঙা আম দুই হাজার ২০০ থেকে তিন হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ বছর প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমির বাগানে হাঁড়িভাঙার ফলন হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ১৫০ কোটি টাকার ওপরে হাঁড়িভাঙা আম বিক্রি হবে বলে জানিয়েছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
হাঁড়িভাঙার মৌসুমে আমের সবচেয়ে বড় হাট বসে রংপুরের পদাগঞ্জ হাটে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। গতকাল শুক্রবার পদাগঞ্জের হাটে সকাল থেকেই অটোরিকশা, ভ্যান ও পিকআপে করে আসতে থাকে ক্যারেটে ক্যারেটে আম। অনেক বিক্রেতাকেই হাটের রাস্তায় সাইকেল ও ভ্যানে ক্যারেটে আম নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আম বেচতে দেখা গেছে। ক্রেতাদের সরব উপস্থিতিতে জমজমাট হয়ে উঠেছে আমের বেচাকেনা।
পদাগঞ্জ ছাড়াও রংপুরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল সড়ক, সিটি বাজার, লালবাগ, মডার্ন মোড়, ধাপ বাজার, শাপলা চত্বরসহ নগরীর বিভিন্ন হাট-বাজারে উঠতে শুরু করেছে এই আম। হাট-বাজার ছাড়াও নগরীর বিভিন্ন অলিগলি ও মোড়ে ফেরি করে হাঁড়িভাঙা আম বিক্রি করতে দেখা গেছে। তবে প্রতিবারের মতো এবারও শুরুতেই আমের চড়া দাম চাইছেন বিক্রেতারা।

এদিকে ক্রেতারা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার আমের দাম একটু বেশি। তবে আকারভেদে দামের পার্থক্য থাকায় কেউ কেউ স্বস্তির কথাও জানিয়েছেন।
আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, হাঁড়িভাঙার ভালো ফলন হওয়ায় অল্প লাভেই বেশি বিক্রির আশা করছেন তারা। তবে এ বছর হাঁড়িভাঙা আমের ফলন ভালো হলেও অনাবৃষ্টি ও অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে আমের আকার খুব বেশি বড় হয়নি।
এদিকে আম পাড়া ও বাজারে সরবরাহকে ঘিরে ব্যস্ততা বেড়েছে আমচাষি, ব্যবসায়ী ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের। আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বড় সাইজের আমের মণ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৭০০ থেকে তিন হাজার ২০০ টাকায়। মাঝারি সাইজের আমের মণ দুই হাজার ২০০ টাকা থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা। আর ছোট সাইজের আম বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার থেকে দুই হাজার ১০০ টাকা মণে। তবে খুচরা বাজারে এর দাম আরও বেশি। কাঁচা আমের তুলনায় আবার পাকা আমের দাম কম। এ ক্ষেত্রে গাছপাকা আম হলে আবার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
পদাগঞ্জ এলাকার আম ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার আমের আকার কিছুটা ছোট হয়েছে। তবে ফলন আশানুরূপ। এবার আবহাওয়ার পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেকেই ২০ জুনের আগেই আম পাড়া শুরু করেছে। আমের আকার বা সাইজভেদে প্রতিমণ আম সর্বনিম্ন দুই হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ তিন হাজার ২০০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। তীব্র গরম না থাকলে, অর্থাৎ সহনীয় তাপমাত্রা থাকলে আমের বাজার কিছুটা বেশি হয় বলেও জানান এই ব্যবসায়ী।
অনলাইনে আম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হাঁড়িভাঙা অনলাইন সার্ভিস আইডিয়াটিকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও তরুণ উদ্যোক্তা সরকার মনজুরুল মান্নান বলেন, কয়েক বছর ধরে অনলাইনে আমের অর্ডার নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে তা সরবরাহ করছি। এবার শুরুর দিনেই ১?৫ মণ আমের অর্ডার পেয়েছি। আজ প্রতি মণ আম আকারভেদে সর্বনিম্ন দুই হাজার ৪০০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ তিন হাজার ৫০০ টাকা করে অর্ডার নেয়া হয়েছে। এসব আম রংপুরের বাইরে পাঠাতে ক্যারেট, প্যাকিং ও কুরিয়ার মিলে বাড়তি খরচ রয়েছে।
এদিকে মিঠাপুকুর উপজেলার আখিরাহাট, খোড়াগাছ, পদাগঞ্জ, মাঠেরহাট, বদরগঞ্জের ওসমানপুর, গোপালপুর, নাগেরহাট, সর্দারপাড়া, রংপুর নগরের বড়বাড়ী ও সদর উপজেলার সদ্যপুস্করণী ইউনিয়নের কাটাবাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিশাল বিশাল বাগানে সারি সারি আমগাছ। জনপ্রিয়তার কারণে এখন রংপুরের তারাগঞ্জ, নীলফামারী সদর, সৈয়দপুর, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা, চিরিরবন্দরসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে এই আমের বাগান। ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এসব বাগান।
এদিকে হাঁড়িভাঙা আম সংরক্ষণে গবেষণা জরুরি বলে দাবি করে চাষি ও ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এই আম পরিবহনের জন্য বিশেষ বাস ও ট্রেন সার্ভিস চালু করা দরকার। একই সঙ্গে ন্যায্য দাম নিশ্চিতকরণে প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে। হাঁড়িভাঙা আমের রাজধানী-খ্যাত পদাগঞ্জ হাটের রাস্তাঘাটের সংস্কার এবং হাটে আম বিক্রির শেড নির্মাণ, ব্যাংকিং সুবিধা বাড়ানো, পাবলিক টয়লেট স্থাপন ও বৃষ্টির সময় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করার জোর দাবি তাদের।
এদিকে শুক্রবার বিকালে রংপুর জেলা প্রশাসনের আয়োজনে পদাগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে হাঁড়িভাঙা আম মেলা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, হাঁড়িভাঙা আম বাজারজাত করতে যাতে কোনো ধরনের অসুবিধা না হয়, তা মনিটরিং করা হবে। বিশেষ করে পরিবহনে ব্যবসায়ীদের যেন কোনো হয়রানির শিকার হতে না হয়, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি সরকারি পরিবহন সুবিধার বিষয়টিও দেখা হবে।
জানা গেছে, রংপুর অঞ্চলে হাঁড়িভাঙা আমের ফলন বেশি হলেও ফজলি, সাদা ল্যাংড়া, কালা ল্যাংড়া, মিশ্রিভোগ, গোপালভোগ, আম্রপালিসহ আরও নানা প্রজাতির আম উৎপাদিত হয়ে আসছে। এসব আমের ভিড়ে এখন সবচেয়ে বেশি চাহিদা হাঁড়িভাঙার। সম্প্রতি হাঁড়িভাঙা আম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।