চতুর্থ প্রজন্মের ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ঊর্ধ্বমুখী

নিজস্ব প্রতিবেদক: নানা সমালোচনা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাথমিক আপত্তি সত্ত্বেও সরকার ২০১৩ সালে নতুন ৯টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লাইসেন্স দেয়; যেগুলো চুতর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। তবে ব্যাংকগুলো যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে, তা থেকে দূরে সরে গেছে। এসব ব্যাংকে এখন খেলাপি ঋণ ক্রমেই বেড়ে চলছে। গত এক বছরে ৯টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ৯টি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ দাঁড়িয়েছে ৮৬ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকায়। এর মধ্যে খেলাপি ৭ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। ওই সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৯টি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে পদ্মা ব্যাংকে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের প্রায় ৬৪ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে ৯৮৮ কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণের অবস্থানে দ্বিতীয় রয়েছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি দাঁড়ায় ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৭ শতাংশ। গত বছর একই সময় ছিল ৬৯৭ কোটি টাকা। এক বছরে বেড়েছে ৩৫৩ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণে পরের অবস্থানে রয়েছে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক। গত সেপ্টেম্বর শেষে এ ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৪৩৪ কোটি টাকা, বা ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। গত বছরের একই সময় ছিল ৪২২ কোটি টাকা। সে হিসাবে খেলাপি বেড়েছে ১২ কোটি টাকা। মেঘনা ব্যাংকের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩৪৮ কোাটি টাকা বা ৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে ছিল ২৫০ কোটি টাকা। এক বছরে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯৮ কোটি টাকা।

এছাড়া এনআরবি ব্যাংকেরও খেলাপি ঋণ বেড়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৩৪৮ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে ছিল ২৩৯ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০৯ কোটি টাকা। মিডল্যান্ড ব্যাংকের এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৩৮ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ রয়েছে ৩২৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ছিল ১৮৮ কোটি টাকা।

অন্যদিকে মধুমতি ব্যাংকের এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪১ কোটি টাকা। ব্যাংকটির সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২৪৬ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময় ছিল ২০৫ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসা শুরুর ১০ বছর পার হলেও ব্যাংকসেবায় বিশেষ কোনো নতুনত্ব আনতে পারেনি চতুর্থ প্রজšে§র ব্যাংকগুলো। গতানুগতিক ধারায় কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা। পর্ষদের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম-দুর্নীতি আর বিভিন্ন ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ছে ব্যাংকগুলো। নানা অব্যবস্থাপনায় নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে নিজেদের ইচ্ছামতো চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠান। ঋণের নামে চলছে লুটপাট। দিন দিন বাড়ছে খেলাপি ঋণের বোঝা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা ব্যাংকপাড়ায় বেশ আলোচনা-সমালোচনার জš§ দিয়েছে।

জানা যায়, ১৯৯২-১৯৯৬ সালে লাইসেন্স পাওয়া দ্বিতীয় প্রজšে§র ব্যাংক এবং ১৯৯৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে অনুমোদিত তৃতীয় প্রজšে§র ব্যাংকগুলোর তুলনায় বেশিরভাগ চতুর্থ প্রজšে§র নতুন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার বেশি।

উল্লেখ্য, রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংকে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর ৩ মাসে খেলাপি ঋণ কমেছে ১১ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। তবে এই সময়ে বেসরকারি খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ফলে আলোচ্য সময়ে পুরো ব্যাংক খাতে সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ কমেছে ৬৪২ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি ৩৯ টাকা, যা সেপ্টেম্বর শেষে কমে হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৬৩ শতাংশের বেশি ১০ ব্যাংকে।

পরিমাণের দিক দিয়ে খেলাপি ঋণের শীর্ষে জনতা ব্যাংক। গত সেপ্টেম্বর শেষে জনতার খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ১ কোটি টাকায়। পরিমাণের দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ১৬ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। পর্যায়ক্রমে সোনালীর ১৩ হাজার ৯৯৩ কোটি, ন্যাশনালের ১৩ হাজার ৫১৫ কোটি এবং রূপালীর ৮ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। এছাড়া শীর্ষ ১০ ব্যাংকের তালিকায় থাকা বেসিক ব্যাংকে ৮ হাজার ২০৯ কোটি, এবি ব্যাংকে ৫ হাজার ৯৪১ কোটি, পদ্মা ব্যাংকে ৩ হাজার ৬৭৩ কোটি ও ইউসিবিতে ৩ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নতুনত্বের নামে বাজারে আসা ব্যাংকগুলোতে আসলে কোনো নতুনত্ব নেই। যেসব এলাকায় ধনাঢ্য মানুষ বেশি, সেসব এলাকায় শাখা খুলেছে তারা। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকায় তাদের শাখা দেয়ার কথা ছিল। অন্যান্য ব্যাংকের মতো শিল্প গ্রুপগুলোর পেছনে দৌড়ায় ওরা।’

তিনি আরও বলেন, ‘এসব ব্যাংক ঋণও দেয় অন্যান্য কনভেনশনাল ব্যাংকের মতোই। কিন্তু নতুন উদ্যোক্তাদের মাঝে বেশি বেশি ক্ষুদ্রঋণ দেয়া উচিত ছিল। সরকারি বড় বড় সংস্থার পেছনে এফডিআর পাওয়ার জন্য ঘুরতে থাকা ইনোভেটিভ (উদ্ভাবনী) ব্যাংকিংয়ের পরিচয় বহন করে না। কিছু কিছু ব্যাংক আছে, যাদের পরিচালকদের সঙ্গে উচ্চমহলের বিশেষ কিছু ব্যক্তির যোগাযোগ আছে। তাদের ইচ্ছামতো এসব ব্যাংক পরিচালিত হয়।’

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০