Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 11:17 am

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে বাংলাদেশের নারী শিক্ষা

মো. রেজুয়ান খান: বাংলাদেশের আট কোটি ২২ লাখ নারীর হাতকে কাজে লাগাতে পারলে দেশ ও জাতির উন্নয়ন সম্ভব। ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি শিক্ষিত জাতি দেব।’ একজন মেয়েকে শিক্ষা দেয়া মানে গোটা পরিবারকে শিক্ষিত করে তোলা। জাতির কল্যাণ ও অগ্রগতিতে নারী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত বাংলাদেশ সংবিধানে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার এবং সমমর্যাদার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। সেই প্রণীত বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের নারীরা আজ প্রযুক্তি শিক্ষায় আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হচ্ছেন। সে একই ধারাবাহিকতায় সমতাভিত্তিক ও ডিজিটাল সমাজ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিস্বরূপ ‘প্ল্যানেট ৫০: ৫০ চ্যাম্পিয়ন’, ‘পিস ট্রি’, ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’, ‘সাউথ-সাউথ’, ‘গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’, ‘চ্যাম্পিয়ন অব স্কিল ডেভেলপমেন্ট’, ‘এসডিজি প্রোগ্রেস অ্যাওয়ার্ড ২০২১’, ‘মুকুটমণি ২০২১’ এবং তথ্যপ্রযুক্তির অলিম্পিক খ্যাত ‘উইটসা ২০২১’ আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুগান্তকারী নেতৃত্বে বাংলাদেশের নারী সমাজ আজ একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার যোগ্য জনশক্তি হিসেবে গড়ে উঠছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে নারীদের অবাধ প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নসহ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন এদেশের নারী। নারীর মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি সর্বত্র নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। নারীর উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে আধুনিক ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরা কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছেন। নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমকালীন বিশ্বে নারী উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মহাসোপানে বাংলাদেশের নারীরা আজ আদর্শ ও নির্ভরযোগ্য।

বর্তমানে শিক্ষার যে ধরনটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছেÑসেটি হলো স্টেম এডুকেশন। সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ম্যাথমেটিকসÑএই চারটি বিষয়ের আদ্যক্ষর নিয়ে সংক্ষেপে স্টেম এডুকেশন। উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক ভিতকে মজবুত করে তুলছে স্টেম এডুকেশন। তাই স্টেম শিক্ষাকেই শিল্পবিপ্লবের মূল উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ইদানীং স্টেম শিক্ষাকে অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশেষ করে ইদানীং বাংলাদেশে স্টেম শিক্ষার প্রতি নারীদের আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে।

স্টেম বিষয়গুলোয় দক্ষতা অর্জন বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে নারীর কর্মশক্তি বাড়াবে। স্টেম শিক্ষার মূল লক্ষ্য হচ্ছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং একুশ শতকের জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তোলা। প্রযুক্তির বিকাশ মানব সভ্যতাকে প্রগতিশীল করেছে। স্টেম শিক্ষা মানুষের সৃজনশীলতাকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। স্টেম শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে বলা যায়, মানুষের মধ্যে উন্নতমানের টিম ওয়ার্ক, উন্নত যোগাযোগ, কোনো কিছু খুঁজে বের করার দক্ষতা, কোনো কিছু বিশ্লেষণ করার দক্ষতা, যেকোনো সমস্যার সমাধান করা, সর্বোপরি ডিজিটাল জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলাই হচ্ছে স্টেমের কাজ। বাংলাদেশের মেয়েরা এখন দেশের সেরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে বিদেশে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। স্টেম শিক্ষা একসময়কার সনাতনী নিয়মে পাঠ্যবই মুখস্থ করার প্রবণতাকে কমিয়ে এনেছে। নারীদের স্টেম শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে। প্রকৌশল এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) মতো চাকরিতে বাংলাদেশ সরকার নারীদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ করে দিচ্ছে। স্টেম ও প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত করে বাংলাদেশের নারীদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লব (৪ওজ)-এর নেতৃত্ব প্রদানকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে স্টেম শিক্ষার দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের সারিতে দাঁড় করাতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

বর্তমানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা ৪ওজ বাংলাদেশের অন্যতম আলোচিত বিষয়। আধুনিক প্রযুক্তি মানুষের জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে বিশ্ব পরিবর্তিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে ন্যাশনাল কাউন্সিল অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ঘঈঝঞ) গঠন করেছে। সারাদেশে ৫ হাজারেরও বেশি ডিজিটাল কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। স্মার্ট এনআইডি, ইউনিক আইডির বায়োমেট্রিক  ডেটাবেজ, আঙুলের ছাপ এবং আইরিস স্ক্যানের মতো ডিজিটাল পরিসেবাগুলো এখন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোয় ব্যবহƒত হচ্ছে। বাংলাদেশের নারীরা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের দারিদ্র্য বিমোচনসহ সাধারণ জনগণের জীবনমান পরিবর্তনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উন্নীত করতে সহায়তা করছে।

সরকারের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের দারিদ্র্য হ্রাস, জিডিপি বৃদ্ধি এবং লাখ লাখ মানুষের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনায় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। সরকার ডিজিটাল সরঞ্জাম পরিচালনা এবং দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে দেশের নারীদের পুরুষদের সমান তালে এগিয়ে যেতে নানান সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। পুরুষ এবং নারীর যৌথভাবে প্রযুক্তিতে সচেতনভাবে দক্ষতা বাড়াতে পেশাগত এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে দেশব্যাপী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নারীদের স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ ‘প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পে শিক্ষার্থী, ফ্রিল্যান্সার, উদ্যোক্তা, পেশাজীবী, গ্রামের বেকার নারীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বনির্ভর হয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করে চলেছে। মূলত নারীকে প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে ‘লার্নিং আর্নিং’, ‘বাড়ি বসে বড়লোক’, ‘মোবাইল প্রশিক্ষণ’ প্রদান ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রশিক্ষণগুলো নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে আরও দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলছে। প্রযুক্তি জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় নারী উদ্যোক্তা গড়ে ওঠার বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী শিক্ষার প্রসার ও নারীর ক্ষমতায়নকে গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করেন। একসময় বাংলাদেশের প্রশাসনে নারীর পদচারণা তেমন লক্ষ্য করা যায়নি। কিন্তু নারীরা এখন প্রথম সচিব, জেলা জজ, জেলা পুলিশ সুপার (এসপি), উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) প্রভৃতি পদে সফলতার সঙ্গে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদানের জন্য গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। শুধু যুক্তরাজ্যই নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার জন্য দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সরকারি-বেসরকারি চাকরির পাশাপাশি কৃষি শিল্পসহ সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। নারীর শিক্ষা অর্জন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য সরকার শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে নানা ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। নারীরা ঘরে বাইরে সর্বত্র কাজ করছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে নারী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল শিক্ষা বাংলাদেশের নারী-পুরুষের মেধাকে আন্তর্জাতিকভাবে বিকশিত করবে, নারীকে করবে আরও ক্ষমতায়িত।

নারী-পুরুষের সমন্বিত প্রচেষ্টায় দেশ যেমন এগিয়ে যাবে, তেমনি দেশের উন্নয়নে নারীদের অবদান আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের ক্ষমতায়ন ঘটবে। কাজেই নারীর ক্ষমতায়নে আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এমন দিন নিশ্চয়ই খুব দূরে নয় যখন নারীরা বাংলাদেশকে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষিত জাতি হিসেবে বিশ্বাঙ্গনে তুলে ধরতে অন্যতম কাণ্ডারি এবং প্রভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে সক্ষম হবে।  

পিআইডি নিবন্ধ