আসাদুজ্জামান বুলবুল: মানবসভ্যতার সূচনালগ্নে যখন মানুষ গুহাবাসী ও যাযাবর ছিল তখন নারী কিংবা পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদ কিংবা ক্ষমতাকেন্দ্রিক বৈষম্য ছিল না। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয় যখন মানুষ যাযাবর থেকে কৃষিভিত্তিক জীবন-জীবিকায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কারণ নারী-পুরুষ যখন একসঙ্গে কৃষিকাজ শুরু করে তখন পেশিশক্তিতে পিছিয়ে পড়ে নারীরা। পুরুষের মতো কায়িক শ্রমে পেরে উঠতে ছিল না। ভারী কাজ করার ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে পড়ে। যখন নারীরা পুরুষদের সঙ্গে কৃষিকাজে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারছিল না তখন তারা স্বাভাবিকভাবে গৃহস্থালি কাজের দায়িত্বে ন্যস্ত হয়। পরোক্ষভাবে তারা চৌকাঠের ভেতরে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় জীবিকার জন্য শারীরিক সামর্থ্যরে প্রয়োজন ছিল বেশি; ফলে অলিখিতভাবে পুরুষের আধিপত্য বিস্তার শুরু হয় নারীদের ওপরে। কৃষিভিত্তিক সমাজের ব্যবস্থার আগে নারীদের সম্মান এবং অবস্থান পুরুষের চেয়ে অনেক গুণ শ্রেয় ছিল। তাছাড়া আমরা পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে নারীদের অনেক বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস পরিলক্ষিত হয়। যেমন মেসোপটেমিয়ার মুরিবেতের মেয়েরাই সর্বপ্রথম ভূমিক-কর্ষণ করে বীজ বুনতে শিখেছিল, যিশু খ্রিষ্টের জšে§র ৮ হাজার বছর পূর্বে। সে সময় প্যালেস্টাইনে মেয়েরা শিখেছিল শস্যক্ষেত্র আর সবজি বাগানের পরিচর্যা করতে, আর তুরস্কের মেয়েরা শিখেছিল গম থেকে রুটি বানাতে। মৃৎ-পাত্র তৈরির রাসায়নিক প্রক্রিয়া, সুতা কাটার বিদ্যা, তাঁতের প্রযুক্তি আর শন ও তুলার রকমারি উদ্ভিদবিদ্যা শেখানোর কৃতিত্ব শুধু নারীদের। নারীরাই প্রথম চিকিৎসক, শিল্পী আর প্রকৌশলী। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, নারীদের কর্মস্থল শুধু রন্ধনশালা আর শয়ন কক্ষেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। নারীগণ পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উন্নয়ন ঘটিয়েছিল সে সময়কার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির। কিন্তু কৃষি বিপ্লবের কারণে নারীরা জ্যামিতিক হারে পিছিয়ে পড়ে সমাজের মূলধারা থেকে। উদাহরণ স্বরূপ আমাদের প্রাচীন ভারতে যখন ইরান বা পারস্য থেকে আর্যরা। নানা কারণে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বের দিকে প্রাচীন ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে অনুপ্রবেশ করে এবং আর্যরা স্থানীয় দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীকে পরাজিত করে আর্যাবর্ত অধিকার করে নেয়। (আর্যাবর্ত প্রাচীন ভারতের অপর নাম) … ক্রমশ আর্যরা চাষাবাদে জড়িয়ে পড়ে এবং গ্রামীণ সভ্যতার বনিয়াদ রচনা করে। এর আগে যাযাবর আর্যদের সমাজকাঠামোটি ছিল ট্রাইবাল এবং তারা বিভক্ত ছিল কৌমে। কৃষিকাজে জড়িত হওয়ার পরই এ কাঠামোটি অর্থনৈতিক সম্পর্কের পালাবদলের কারণেই ভেঙে পড়েছিল এবং আর্যসমাজে ‘কুল’-এর উদ্ভব হয়েছিল। কিন্তু কুল কি? কুল মানে একটা বাড়িতে তিন-চার পুরুষের ডালপালা ছড়ানো বড় পরিবার যে বাড়ির প্রতিটি বয়স্ক পুরুষ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত, অর্থাৎ যে বাড়ির প্রতিটি বয়স্ক পুরুষ ফসলের মাঠে কাজ করে। এই সময়ে সমাজে নারীর মর্যাদা হ্রাস পেতে থাকে। কেননা, নারী উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। যদিও বৃহৎ পরিবারে নারীর সাংসারিক কাজকর্ম ছিল। তবুও সংসারের নিত্যদিনের কাজের মধ্যেই নারীর ভূমিকা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। অর্থাৎ ইতিহাস পর্যালোচনা করে পরিলক্ষিত হচ্ছে শারীরিক সক্ষমতার প্রয়োজন বেড়ে যাওয়ার কারণে নারীদের ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে সমাজে। তাছাড়া প্রাচীনকালের অনেক সংস্কৃতিতে মহিলাদের জন্য পুরুষ কর্তৃক তৈরি নিয়?ম এবং নিয়?মগুলোর অসুবিধাগুলোর বিরুদ্ধে লড়?াই করতে হয়ে?ছিল। ফলে নারীরা সমাজের মূলধারা থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। এঙ্গেলস তার ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ (১৮৮৪) নামের কালোত্তীর্ণ বইটিতে দেখিয়েছেন ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্ভবের সাথে সাথে এক সময় সম্পদ বাড়তে থাকে, আর এ সম্পদই শেষ পর্যন্ত নারীর শত্রু হয়ে দেখা দেয়। অরণ্য পর্ব থেকে মানুষ যখন পৌঁছায় কৃষিপর্বে, তখন সম্পদশালী হয়ে উঠে বিভিন্ন গোত্র। এক সময় এ সম্পদ অধিকারে চলে আসে গোত্র পতিদের। তারা হয়ে উঠে সম্পদশালী। উদ্ভাবন ঘটে ব্যক্তিগত মালিকানার। সম্পদ যত বৃদ্ধি পেতে থাকে পরিবারে নারীদের থেকে পুরুষদের গুরুত্বও বৃদ্ধি পেতে থাকে। মাতৃতন্ত্র ভেঙে সৃষ্টি হয় পিতৃতন্ত্র। নারী পরিণত হয় পুরুষের সম্পত্তিতে।
আশার কথা হচ্ছে, কৃষি যুগের অবসান হয়ে এখন বিশ্ববাসীর সামনে হাতছানি দিচ্ছে চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের। চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের প্রভাবে নারীরা আবার সমাজের চালকের আসনে বসবে। নারীরা কেমন করে আবার ক্ষমতায়নের কেন্দ্রবিন্দুতে যাবে এবং একটি নারীতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রচলন করে তা বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছি।
আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখলাম শারীরিক সামর্থ্যরে কাছে হেরে গিয়ে নারীরা পিছিয়ে পড়ে সমাজ থেকে। কিন্তু এই শতাব্দীতে শিল্প-বিপ্লবের ফলে শারীরিক সামর্থ্যরে চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্যরে গুরুত্ব জ্যামিতিক হারে বাড়বে।
কারণ একটা কল-কারখানার হাজার হাজার মেশিন পরিচালনার জন্য শত শত মানুষের প্রয়োজন পড়বে না। একটি সুইচে চাপ দিলে কল-কারখানার মেশিন সচল হবে।
এখন একটি সুইচ চাপার জন্য ছেলে, মেয়ে কিংবা শারীরিক শক্তিমত্তার বিভেদ থাকবে না। কারণ একটা পুরুষের স্পর্শ যেমন চালু হবে যন্ত্র তেমনি একটি নারীর স্পর্শেও চালু হবে সেই যন্ত্রটি।
অর্থাৎ শিল্প-বিপ্লবের ফলে পুরুষের এগিয়ে যাওয়ার যে প্রধান নিয়ামক শক্তিমত্তা ছিল সেটির গুরুত্ব থাকবে না একেবারেই। শারীরিক শক্তিমত্তার বদলে কদর বাড়বে সৃজনশীল ও উন্নত চিন্তা শক্তির মানুষের আর আমরা দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাবো জ্ঞান-বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনে নারীরা অনেক এগিয়ে যেমনÑ
আধুনিক সমাজ-বিজ্ঞানী, প্রতœ-তাত্ত্বিক এবং নৃ-তত্ত্ববিদদের মতে, মানব সভ্যতার শুরুতে নারী-পুরুষের অবদান ছিল সমানে সমান। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীর অবদান বরং বেশিই ছিল। অনুমান করা হয় আগুনের আবিষ্কারক ছিল নারী। নারীই প্রথম আগুন ও তাপ দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে খাদ্য-সংরক্ষণ করতে শিখেছে।
তারেই ধারাবাহিকতায় লক্ষ্য করলে দেখব আধুনিক সময়েও কতটা সৃজনশীল নারীরা যেমন পৃথিবী ভালো ভালো গবেষণাগারগুলোর দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে, নারী-পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আধুনিক বিশ্বে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে সাফল্যের সাথে কাজ করছেন লিজা রান্ডল, ইভা সিলভারস্টাইন, সিএসউ, ভেরা রুবিন, জোসলিন বেল প্রমুখ। জীববিজ্ঞান, নৃ-তত্ত্ব, ইতিহাস এবং বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানসহ অন্যান্য শাখায় সাফল্যের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন বনি ব্যাসলার, লরা বেটজিগ, এলিজাবেথ ক্যাসদান, লিডা কসমাইডস, হেলেনা ক্রনিন, মিল্ডার্ড ডিকম্যান, হেলেন ফিশার, প্যাট্রিশিয়া গোয়াটি, ক্রিসেন্ট হকস, সারা বাফার হার্ডি, ম্যাগদালিনা হুর্টাডো, ববি লো, লিন্ডা মিলে, ফেলিসিয়া প্রাত্তো, মেরিন রাইস, ক্যাথেরিন স্যামোন, জোয়ান সিল্ক, মেরিডিত স্মল, বারবারা স্মুটস, ন্যান্সি থর্নহিল, মার্গো উইলসন প্রমুখ নারী বিজ্ঞানীগণ। তাছাড়া নিজের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও সৃজনশীলতার জন্য ইতিহাসের পাতায় নিজেদের স্থান করে নিয়েছে কিছু বিখ্যাত নারী। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হাইপেশিয়া, মাদাম কুরি, লরা বেসি, সোফিয়া কোভালেবস্কায়া, লিস মিন্টার, ক্যারলিন হারসেল, মেরি অ্যানি ল্যাভরশিয়ে, খনা, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত, মাদার তেরেসা এবং ডিএনএ’র উদ্ভাবক রোজালিন ফ্র্যাঙ্কলিন প্রমুখ।
তাহলে স্পষ্ট যে আগামী বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বে নারীরা আবার ফিরে পাবে তাদের প্রাচীন জৌলুস। কারণ নারীরা সৃজনশীল, কষ্ট সহিষ্ণু, তারা মননশীল তারা প্রতিকূলতাকে জয় করতে জানে। আগামীর বিশ্বে যে জ্ঞান বিজ্ঞানের জয়জয়কার সূচিত হবে, সেখানে পুরুষতান্ত্রিক ইতিহাসের জাল ভেদ করে নারীর জন্য একটি বৈষম্যহীন পৃথিবী উপহার দিতে পারবে। তবে নারীর এই অগ্রযাত্রার থেকে অবরুদ্ধ ও সংকোচিত করা যাবে না, পুরুষদের সহমর্মিতা ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে নারীর কল্যাণে। নারীদের প্রতিযোগী না ভেবে সহযোগী ভাবতে হবে এবং তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করতে হবে। তাছাড়াও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তাহলো নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী হতে হবে পুরুষ সমাজের তবেই নারীর বন্ধুর পথ মসৃণ হবে এবং নিজেদের বিকশিত করার সুযোগ পাবে। আমরা আশা করব সকল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এগিয়ে যাক আমাদের নারী সমাজবঞ্চনা, করুণা অবহেলিত অবস্থার শিকল ভেঙে আলোকিত হোক নারীরা।
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়