চরফ্যাশন: পর্যটনশিল্পের এক সম্ভাবনাময় স্থান

ভোলা জেলার একটি উপজেলা ও বড় শহর চরফ্যাশন। এ উপজেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য চর। এখানে রয়েছে পর্যটনশিল্প বিকাশের নানা উপকরণ। প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে চরফ্যাশন হয়ে উঠতে পারে চমকপ্রদ ও আকর্ষণীয়। এখানকার জীববৈচিত্র্য ও দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে সহজেই। এ উপজেলা কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি একটি পরিকল্পিত নগরীরও উদাহরণ।

এখানে অবস্থিত সুউচ্চ জ্যাকব টাওয়ার। রয়েছে শেখ রাসেল শিশু ও বিনোদন পার্ক, খামারবাড়ি, ফ্যাশন স্কয়ারসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। অপরদিকে চর কুকরি-মুকরি পরিণত হয়েছে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে। সবুজ গাছগাছালি, বিস্তীর্ণ জলরাশি, নানা প্রজাতির প্রাণীর অভয়ারণ্য হলো চর কুকরি-মুকরি। এখানে পর্যটকদের জন্য হোম স্টে সার্ভিসের ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে পর্যটনবান্ধব নানা উদ্যোগ। পর্যটকদের জন্য আরেকটি আকর্ষণীয় স্থান হলো ঢাল চরের তারুয়া সমুদ্রসৈকত। এখানে পর্যটকদের চোখে ধরা দেয় লাল কাঁকড়াসহ নানা প্রজাতির অতিথি পাখি। বেতুয়া প্রশান্তি পার্কও দর্শনার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। মেঘনা নদীর পাড়ে গড়া ওঠা এ পার্কে পর্যটকদের আনাগোনা লেগেই থাকে।

চরফ্যাশনের মানুষ একসময় উন্নয়নে পিছিয়ে থাকলেও এখন উন্নয়নের হাওয়া লেগেছে কমবেশি সবখানে। মানুষের জীবনযাত্রায় এসেছে পরিবর্তন। ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে গতিশীল। শিক্ষার আলো, বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। রাস্তাঘাটের চেহারায়ও লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। চরফ্যাশনের মতো একটি সম্ভাবনাময় উপজেলা পর্যটন খাতকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাবে, এটাই প্রত্যাশা।

এখানকার নদনদীগুলো মানুষের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। চরফ্যাশন তথা দ্বীপ জেলা ভোলাকে ভিন্নমাত্রা দান করেছে এ নদীই। উপজেলার অধিকাংশ মানুষ মৎস্য আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। দেশের মানুষের মৎস্য চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তারা। কৃষি ক্ষেত্রেও এখানকার মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।

তাদের (জেলে) বৃষ্টিতে ভেজা ও রোদে শুকানোর কঠোর পরিশ্রমে আমরা নিজেদের মাছে-ভাতে বাঙালি বলতে পারছি। কিন্তু জেলেরা কি অন্য দশজনের মতো খেয়ে-পরে দিন কাটাতে পারছেন? অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা অধিকারবঞ্চিত। অনেকের সংসারে উনুনটুকুও ঠিকমতো জ্বলে না। আবার প্রায়ই ট্রলার ডুবে জেলেদের মৃত্যু সংবাদ আমরা পত্রিকার পাতায় দেখতে পাই। দেখা যায়, জেলে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটির মৃত্যুর ফলে এসব পরিবারে নেমে আসে দারিদ্র্যের কশাঘাত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা সামান্য কিছু অর্থ সাহায্য পেলেও তা যথেষ্ট নয়।

ঢাকা শহর কিংবা অন্যান্য জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক কার্যাবলি সম্পাদনে এখানকার মানুষের নৌপথই ভরসা। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ায় নৌপথে যোগাযোগ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। আবার দেখা যায়, এখানকার পোশাকশিল্পের কর্মী কিংবা জনসাধারণকে দ্রুত সময়ে ঢাকা পৌঁছাতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। অনেক সময় গন্তব্যে ঠিক সময়ে পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে যায় তাদের। ভোলা জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় চরফ্যাশন উপজেলার শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুষ্টিয়াসহ দেশের নানা প্রান্তে যেতে হয়। কিন্তু নৌপথে সময়সাপেক্ষ যাত্রার ফলে তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়। বাড়িতে বেড়াতে এসে অনেক সময় ক্যাম্পাসে গিয়ে ক্লাস-পরীক্ষা ধরা অসম্ভব হয়ে ওঠে তাদের জন্য। চাকরির পরীক্ষার্থীরাও যথাসময়ে ঢাকা গিয়ে পরীক্ষাগুলোতে বসতে ব্যর্থ হন, যার একটি নজির হলো, ৪৩তম বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিতে শতাধিক পরীক্ষার্থীর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারা। তখন দেশের একটি জনপ্রিয় দৈনিকের শিরোনাম হয়েছিল এই যে, লঞ্চে তলিয়ে গেল শতাধিক বিসিএস পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন, যা কখনও সুখকর নয় জাতির জন্য। আমরা চাই না আর কোনো বিসিএস পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন লঞ্চে তলিয়ে যাক।

চর অঞ্চলের অনেক মানুষ এখনও আধুনিক জীবনযাত্রা বলতে কী বোঝায় তাও বলতে পারে না। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রয়েছে তাদের ছেলেমেয়েরা। স্বাস্থ্যসেবায়ও অনেক পিছিয়ে রয়েছে তারা। এসব চরে পর্যটনশিল্পের অপার হাতছানি থাকলেও গড়ে ওঠেনি তেমন কিছুই। আবার কর্তৃপক্ষ কোথাও কোথাও উদ্যোগ নিলেও তা পর্যটকদের কাছে সেভাবে পরিচিতি পায়নি। চর অঞ্চলে পরিকল্পিত পর্যটন গড়ে উঠলে শহরে থেকে আসা মানুষরা যেমনি প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ পাবে, তেমনি চরের অসচ্ছল পরিবারগুলো আশার আলো দেখতে পাবে।

উপজেলা শহরে নাগরিক জীবনের উন্নত সেবা পাওয়া গেলেও গ্রামগুলোয় এখনও কচ্ছপ গতির নেটওয়ার্ক সেবা লক্ষণীয়। এর ফলে শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটে ক্লাস করতে বেগ পেতে হয়। এখনও এখানে তেমন পাঠাগার গড়ে না ওঠায় শিক্ষার্থীদের মাঝে বই পড়ায় অনীহা লক্ষণীয়। তাদের অনেকে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে, যা কখনও কাম্য নয়। কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বইমুখী তরুণসমাজ গঠনে চরফ্যাশন উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে অন্তত একটি করে পাঠাগার গড়ে তোলা যায়। চরফ্যাশন উপজেলায় পর্যটনশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এখানে পর্যটনবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। পর্যটকদের নিরাপত্তা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, আবাসন সংকট নিরসনসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পর্যটকদের নিশ্চিত করা গেলে চরফ্যাশন হয়ে উঠবে দেশের অন্যতম টুরিস্ট স্পট।

এ উপজেলায় পর্যটনের রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। চরফ্যাশনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় স্থানগুলোর কথা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে হবে। এর মাধ্যমে চরফ্যাশনের অর্থনীতি এগিয়ে যাবেÑএমনটিই প্রত্যাশা রইল।

মারুফ হোসেন

শিক্ষার্থী

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০