রেজাউল করিম খোকন: চলচ্চিত্র শিল্পে মেধা ও সৃজনশীলতায় উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৬ সাল থেকে সিনেমা নির্মাণের জন্য প্রতি বছর সরকারি অনুদান দেয়া হয়ে থাকে। মাঝে কয়েক বছর বন্ধ থাকলেও ২০০৭-২০০৮ অর্থবছর থেকে আবারও তা নিয়মিত হয়েছে। তবে গত কয়েক বছর ধরে এই অনুদান দেয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন আর বিতর্ক উঠছে। অভিযোগ আছে, সিনেমা নির্মাণের জন্য এমন মানুষ অনুদান পান, যাদের অর্থের অভাব নেই। আবার পরিচালনায় পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই এমন পরিচালকও পাচ্ছেন অনুদান। কাদের, কী কারণে এবং কোন পদ্ধতিতে অনুদানের জন্য মনোনীত করা হয়, সেই প্রশ্নও আছে। অনুদানের চেক পাওয়ার নয় মাসের মধ্যে একটি সিনেমা তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কারও দেরি হলে তারা যুক্তিসঙ্গত কারণে দেখালে মেয়াদ বাড়াতে পারে। কিন্তু কয়েক বছর আগে অনুদান পেয়েছেন কিন্তু এখনও সিনেমার কাজ শেষ করতে পারেননিÑএমন উদাহরণও অনেক আছে। আবার যোগাযোগ, তদবির এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় অপেশাদাররাও বছর বছর অনুদান বাগিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ। ফলে রাষ্ট্রের টাকার কেবল অপচয় হচ্ছে বছরের পর বছর। একটি ভালো সিনেমা নির্মাণ করে দর্শক পর্যন্ত পৌঁছাতে মেধাবী পরিচালকের সঙ্গে পেশাদার একজন প্রযোজকও অপরিহার্য। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া একটি সিনেমার জন্য ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬০ লাখ টাকা সরকারি অনুদান পান প্রযোজক । সিনেমা মুক্তির আগে এ সিনেমার নায়িকা প্রযোজক এবং তার অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে বেশকিছু অভিযোগ তোলেন। তিনি অভিযোগ করেন, সিনেমা নির্মাণের জন্য প্রযোজক ৬০ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছেন। কিন্তু তিনি ২০ লাখ টাকাও খরচ করেননি। এছাড়া সিনেমা প্রযোজনার পূর্ব অভিজ্ঞতাও নেই সেই প্রযোজকের। তিনি রাজনৈতিকভাবে প্রভাব খাটিয়ে সরকারি অনুদান পেয়েছেন বলে নানা মহলে গুঞ্জন। এদিকে, একই বছর দেশের শীর্ষ এক নায়ক এবং তার সাবেক স্ত্রী অভিনেত্রীও অনুদান পেয়েছেন। নানা প্রশ্ন উঠেছে এই দুই তারকার অনুদান পাওয়া নিয়েও। তারা দুজনেই বেশ বিত্তশালী। কীভাবে তারা সরকারি অনুদান পান বা নেন, এই নিয়ে চলছে কানাঘুষা। তাহলে কি যে কেউ সরকারি অনুদান পেতে পারেন? মূলত সিনেমার চিত্রনাট্য বাছাইয়ের ওপর সরকারি অনুদান দেয়া হয়ে থাকে। যার চিত্রনাট্য বা গল্প ভালো তিনিই অনুদান পান। সেক্ষেত্রে প্রযোজক-পরিচালক কোনো বিষয় নয়। অন্যদিকে, অনেক নির্মাতাই রয়েছেন যারা সরকারি অনুদান নিয়ে বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছেন। কেউ সিনেমা শেষই করতে পারছেন না, কেউ আবার সিনেমা শেষ করলেও সেটির মুক্তি আটকে আছে নানা কারণে। যেখানে সরকারি অনুদানের জন্য অন্যতম প্রধান শর্ত থাকে, অনুদানের প্রথম চেক প্রাপ্তির ৯ মাসের মধ্যে ছবির কাজ শেষ করতে হবে। তবে বিশেষ অবস্থায় অনুরোধ সাপেক্ষে পরিচালক ওই সময় বৃদ্ধি করতে পারেন। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেকে নির্মাণের জন্য বছরের পর বছর সময় পার করছেন। মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণির কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশের কারণে এ ধরনের কাজ করে অনেক পরিচালক-প্রযোজক পার পেয়ে যাচ্ছেন। যার কারণে নির্মাতাদের কোনো ধরনের জবাবদিহি করতে হয় না। এ অভিযোগে বেশ কয়েকজন নির্মাতার নামে মামলাও হয়েছে। অনুদানের অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার অবসান চেয়ে বহুবার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পর্ষদের নেতারা। দেশীয় চলচ্চিত্রে শিল্পগুণসম্পন্ন নান্দনিক ও নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুদান প্রদানের পদ্ধতি শুরু হয়েছিল। শুরুর দিকে সরকারি অনুদানেই নির্মিত হয়েছিল ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ এবং ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’র মতো কালজয়ী চলচ্চিত্র। কিন্তু চলচ্চিত্র অনুদানে এই শিল্পগুণধর্মী চলচ্চিত্রের ধারা বহমান থাকেনি। বিগত বছরগুলোতে অনুদান প্রদানের প্রক্রিয়াটি বিতর্কিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে চলচ্চিত্রের মান এবং গুণও। বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র সমালোচক ও লেখক এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কার্যত সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তথ্য মন্ত্রণালয়কে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতেও দেখা যায়নি। আমরা চাই, চলচ্চিত্র অনুদানের এই রাষ্ট্রীয় প্রণোদনাটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহি প্রক্রিয়ায় গতিশীল থাকুক। চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য সরকার অনুদান দিচ্ছে। এটা দিয়ে অনেকেই ব্যক্তিগত উন্নয়নে ব্যস্ত। কোনো সিনেমাই সময়মতো শেষ হচ্ছে না। সরকার চলচ্চিত্রকারদের সাহায্য করছে, সহযোগিতা করছে। সময়মতো কাজ শেষ করা তাদের দায়িত্ব। অনেকগুলো সিনেমা আছে ছয়-সাত বছর ধরে তৈরি হচ্ছে। এটা সিনেমায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একটা সময় তো সেই সিনেমার প্রহণযোগ্যতাই থাকে না। প্রতি বছর অনুদানের সিনেমার ঘোষণা আসে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় শর্ত সাপেক্ষে ছবির আহ্বান করে। নিয়ম মেনে প্রযোজকেরাও চিত্রনাট্য জমা দেন। অনুদানপ্রাপ্তির পরই যেন অনেক প্রযোজক ভুলে যান সব নিয়ম। ব্যতিক্রম থাকলেও বেশির ভাগ প্রযোজকই যেন নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না। গত দুই অর্থবছরের অনুদান পাওয়া সিনেমাগুলোর দিকে তাকালে সে চিত্র দেখা যায়। গত দুই বছরে করোনার অজুহাত দেখিয়ে অনেক প্রযোজক ও পরিচালক বিলম্বে শুটিং শুরু করেন। পরিস্থিতি ভালো হলেও অনেক সিনেমার অগ্রগতি হতাশাজনক। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়
থেকে চিঠি দেয়া হলেও প্রযোজকেরা সময় চেয়ে পাল্টা চিঠি দিচ্ছেন। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অনুদানের সিনেমা সঠিক সময়ে জমা পাচ্ছে না তারা। আইনের আশ্রয় নেয়ার কথাও ভাবছে তারা। সরকারি অনুদানের ছবির কাজ শুরু হয়, কিন্তু শেষ হয় না। অনুদানপ্রাপ্ত বেশির ভাগ ছবির ক্ষেত্রেই এই অনিয়ম দীর্ঘদিন ধরে নিয়মেই পরিণত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি কোনো কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থাও নেই। চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদান মানে অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। অনুদান পাওয়ার পর অনেক নির্মাতা ‘একটি ছবি নির্মাণে এই অর্থ যথেষ্ট নয়’ এই অজুহাত দেখিয়ে ও অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করেন। অথচ নির্মাতারা অনুদানের অর্থের পরিমাণ জেনেই আবেদন করেন। তাহলে অর্থ পাওয়ার পর কেন ছবি নির্মাণে খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের চেষ্টা করা? সব মিলিয়ে সরকারি অনুদানের টাকা নিয়ে নয়ছয় কোনোভাবেই থামছে না। আরেকটি অভিযোগ হলো, চিত্রনাট্যের সঙ্গে জমা দেয়া শিল্পীর তালিকায় খ্যাতনামা শিল্পীদের নাম জমা দিয়ে অনুদান আদায়ের পর উল্লেখিত শিল্পীদের না নিয়ে ছোটখাটো শিল্পীকে নামমাত্র অর্থ বা বিনা অর্থে কাজ করিয়ে নেয়া হয়। আবার শিল্পী না নিয়ে নির্মাতা নিজের আত্মীয়স্বজন দিয়ে অভিনয় করান। এরপরও কারচুপি আছে। আর তা হলো স্পন্সর বা একজন প্রযোজককে প্রলুব্ধ করে তার কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে কোনোভাবে ছবির কাজ শেষ করে তা টিভি চ্যানেলের কাছে বিক্রি করে দিয়ে সেই নির্মাতা অসাধু পথে লাভবান হন। একটি ছবি নির্মাণ করতে দেড় বছরের বেশি সময় লাগা উচিত নয়। অনুদান প্রদান কমিটিতে দুর্বলতা থাকতে পারে। চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, সরকারি অনুদানের ছবি কে দেখে, কোথায় প্রদর্শন হয়, এসবের নির্মাণকাজ কখন শেষ হয়, আদৌ শেষ হয় কি নাÑএই বিষয়গুলো সরকারসহ কেউই জানে না। একসময় অনুদানের অনেক সিনেমা হলে মুক্তি পেত না, অনেকগুলো আর্টফিল্মের জন্য অনুদান দেয়া হলেও বানায়নি বা বানালেও সেটা কেউ জানে না যেসব ছবি বানানো হয়নি। মানে সরকারি অর্থ নিয়ে নয়-ছয় করার এক বিরাট খাতের নাম হচ্ছে ‘চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সরকারি অনুদান প্রথা’। এই অনুদান প্রথা বন্ধ করে ওই অর্থ চলচ্চিত্রের উন্নয়নে অন্য খাতে ব্যয় করা যেতে পারে। দেশের চলচ্চিত্র প্রতিকূলতার মধ্যেও ভালোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালে আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প যাত্রা শুরুর পর বহু কালজয়ী ছবি যেমন জš§ দিয়েছে, বহু কালজয়ী নায়ক-নায়িকারও জš§ দিয়েছে এবং আমাদের অনেক ছবি স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, স্বাধীনতাসংগ্রাম, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশ গঠনে অবদান রেখেছে। বহু ছবি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুরস্কৃত হয়েছে, প্রশংসিত হয়েছে। আমাদের ছবি এখন শুধু আমাদের সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়, ইউরোপ-আমেরিকাসহ অনেক দেশে প্রদর্শিত হয়। ভবিষ্যৎ প্রজš§কে দেশের মানুষ, প্রকৃতি, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস, সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদানে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সচিত্র প্রামাণ্য ইতিহাস আমরা জানতে পারি মূলত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র থেকেই। অথচ সরকারি অনুদানে পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্র আজ উপেক্ষিত। গত কয়েক বছর এই শাখায় একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্রকেও সরকারি অনুদান প্রদান করা হয়নি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। বাংলাদেশের প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড, এ স্টেট ইজ বর্ন, আলমগীর কবিরের লিবারেশন ফাইটার্স ও বাবুল চৌধুরীর ইনোসেন্ট মিলিয়নস। পাকিস্তানিদের গণহত্যা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অবহিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ত্বরান্বিত করার পেছনে এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৯৫ সালে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ নির্মাণ করেন প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘মুক্তির গান’ যা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রামাণ্য দলিল। সেই গৌরবময় ইতিহাসের প্রামাণ্যচিত্র আজ উপেক্ষিত। সরকারি অনুদানের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সরকারের প্রস্তাব আহ্বানের ঘোষণায় বলা হয়ে থাকেÑ ‘বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখবে এবং একই সঙ্গে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন জীবনমুখী, রুচিশীল ও শিল্পমানসমৃদ্ধ গল্পের চলচ্চিত্রকে প্রাধান্য দেয়া হবে।’ আবহমান সংস্কৃতি, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের চেয়ে ভালোভাবে আর কোথায় উপস্থাপিত হতে পারে? সরকারি অনুদানে পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের প্রতি বৈষম্য দূর হোক। কয়েক বছর ধরে সিনেমা হলের সংকট চলছে। এটাই এখন বড় সংকট। এছাড়া অনুদানের ছবি নিয়ে অনিয়ম, অরাজক অবস্থাও চলছে। সরকার চলচ্চিত্র উন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছে। অনুদান নিয়ে মানসম্পন্ন সিনেমাও বানাচ্ছেন না অনেক প্রযোজক। চলচ্চিত্রে সততার কোনো বিকল্প নেই। সরকারের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে যারা ছবি বানান, তাদের অনেকেরই সততার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যারা অনুদান পান তাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বÑসেই চলচ্চিত্রকে দর্শকউপযোগী করে তোলা। অনুদানের গল্প এত সুন্দর, কাস্টিংও ভালো, এরপরও কেন অনুদানের ছবি চলবে না? বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ক’টি
অনুদানের ছবি হিট হয়েছে? এসব বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় এসেছে। দর্শক চাহিদার কথা মাথায় রেখে সবারই সময়োপযোগী চলচ্চিত্র নির্মাণ করা উচিত।
-অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক