Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 10:28 pm

চলচ্চিত্র নির্মাণ-প্রদর্শন ব্যবস্থায় নতুন স্বাধীনতার অঙ্গীকার বয়ে আনুক

রেজাউল করিম খোকন: চলচ্চিত্রকর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে সেন্সর বোর্ড যুগের ইতি ঘটল। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ গঠন করেছে সরকার। চলচ্চিত্রকর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে সেন্সর বোর্ড বাতিল করে গঠিত হয়েছে ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’। এ ‘সার্টিফিকেশন’ বোর্ডের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কোনো সিনেমাই এখন থেকে নিয়মের বেড়াজালে ঝুলে থাকবে না। ২০২৩ সালের গেজেটেড আইনের বিধিমালা অনুযায়ী শিগগিরই শুরু হবে ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’-র কাজ। আশা করা হচ্ছে, নতুন জারি হওয়া প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দীর্ঘ ৬০ বছরের সেন্সর বোর্ডে সিনেমা ঝুলে থাকার সংস্কৃতির অবসান হবে ঢালিউড ইন্ডাস্ট্রির। এতদিন ১৯৬৩ সালের পুরোনো আইন অনুসরণ করে চলছিল সেন্সর বোর্ড। যে কারণে নানা নিয়মের বেড়াজালে প্রায়ই আটকে যেত নতুন নির্মিত সিনেমা। দীর্ঘদিন ধরে সেন্সরে সিনেমা আটকে থাকার সমস্যায় আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন সিনেমা নির্মাণের কারিগর প্রযোজক ও পরিচালকরা। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিলেন আটকে থাকা সিনেমায় অভিনয় করা অভিনয়শিল্পীরা।

সে সমস্যার সমাধানেই সংস্কারের দাবি তোলেন চলচ্চিত্রকর্মীরা। দেশে সরকার পতনের পর এবার ঢালিউড ইন্ডাস্ট্রির দীর্ঘদিনের এ সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসেছে সংস্কারবাদী সরকার। বর্তমান সময়ের উপযোগী করে ‘সেন্সর বোর্ডের’ নাম পরিবর্তন করে গঠিত করা হয়েছে ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’। ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন, ২০২৩’-এর ৩ ধারার উপধারা (১) অনুযায়ী ১৫ সদস্যের সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠিত হয়েছে। নতুন বোর্ডের কাজ ২০২৩ সালের গেজেটেড আইনের বিধিমালা অনুযায়ী শুরু হবে। তবে ২০২৩ সালে সেন্সর সার্টিফিকেশন বোর্ডের যে আইন করা হয়েছে সেটির কোনো বিধিমালা এখনও তৈরি হয়নি। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেই বিধিমালা তৈরি করা হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এখন ছুরি-কাঁচি চালিয়ে ছবি মুক্তি আটকানো যাবে না। বরং অন্যান্য দেশের মতো দর্শকের বয়স অনুযায়ী, গ্রেড হয়ে যাবে সিনেমার ধরন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন করে সরকার। তবে সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠন না করে ১৯৬৩ সালের ‘সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট’-এ ‘সেন্সর বোর্ড’ পুনর্গঠনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন নির্মাতা, চলচ্চিত্র সংগঠকেরা। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যে সার্টিফিকেশন বোর্ড করেছে সরকার। দ্রুততার সঙ্গে চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইনের বিধিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে। বিধিমালা প্রণয়ন হলেই আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন শুরু হবে।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইনের বেশির ভাগ ধারা সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট থেকে নেয়া হয়েছে। খসড়া প্রণয়নের পর দফায় দফায় আইনটি নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন চলচ্চিত্রকর্মীরা। কয়েকটি ধারার সঙ্গে সার্টিফিকেশন আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিকও। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সার্টিফিকেশন আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হবে। ২০২৩ সালের যে আইন রয়েছে, সেই আইনও অনেক ত্রুটিপূর্ণ। চলচ্চিত্র নির্মাতা, চলচ্চিত্র শিক্ষক, চলচ্চিত্র গবেষক ও চলচ্চিত্রকর্মীদের আপত্তি আমলে না নিয়েই আইনটি পাস করেছে বিগত সরকার। সার্টিফিকেশন আইনেও কোনো চলচ্চিত্রের সার্টিফিকেশন সাময়িক স্থগিত বা বাতিলের অধিকার রাখা হয়েছে। সার্টিফিকেশন আইনের বেশ কিছু ধারা নিয়ে চলচ্চিত্রকর্মীদের প্রশ্ন রয়েছে। আইনটি কার্যকর হওয়ার পর তারা সংস্কার চাইবেন। আইনের গ্রেডিং প্রথাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন তারা। সার্টিফিকেশন বোর্ডও সেন্সর বোর্ডের মতোই ছবি দেখবে। তবে সার্টিফিকেশন বোর্ড কোনো ছবি আটকানোর জন্য দেখবে না। ছবিটি কোন বয়সের মানুষ দেখতে পারবে, কোন বয়সের মানুষ দেখতে পারবে না, সেটা নির্দিষ্ট করবে সার্টিফিকেশন বোর্ড।

হলিউড, বলিউডসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের চলচ্চিত্রে সেন্সর-প্রথা নেই; সার্টিফিকেশন বোর্ড রয়েছে। সেন্সর বোর্ড, একটা প্রাগৈতিহাসিক প্রথা। যেটা দিয়ে সিনেমা কিংবা শিল্পচর্চাকে আটকে দেয়া হতো। কোনো কারণ ছাড়াই আটকে দেয়া হয়েছে অনেক ছবি। আবার অনেক সিনেমা কাটছাঁট করা হতো। এই পুরো প্রথাই শিল্পের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। শিল্পীর কাজ হচ্ছে, উš§ুক্তভাবে শিল্পচর্চা করা। সেন্সর বোর্ডের ন্যারেটিভের মধ্যে শিল্পীর চিন্তাকে বন্দি রাখার চেষ্টা করা হতো। কেউ কেউ বলেন, সেন্সর বোর্ড না থাকলে অশ্লীলতা চরম আকার ধারণ করবে। কাটপিসের যুগেও কিন্তু সেন্সর বোর্ড ছিল। কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আবার ওটিটির শুরুর দিকে কেউ কেউ বলছিলেন, ওটিটিতে অশ্লীলতা প্রচার করা হচ্ছে; ওটিটি বন্ধ করা হোক কিংবা নীতিমালা করা হোক। পরে কিন্তু কোনো নীতিমালা ছাড়া, সেন্সরশিপ ছাড়াই ভালো ভালো কাজ হয়েছে। এগুলো দর্শকেরা গ্রহণ করেছে। এগুলো কোনো নীতিমালা কিংবা সেন্সর বোর্ড দিয়ে দিয়ে আটকানো হয়নি। যেটা গ্রহণ করার, সেটা দর্শক গ্রহণ করবেই। পৃথিবীর কোথাও সেন্সর বোর্ড নেই। সেন্সর বোর্ড ঠিক করে দিতে পারে না, দর্শকেরা কি দেখবে, আর কি দেখবে না।

বিভিন্ন দেশে সার্টিফেকশন বোর্ড থেকে সিনেমার গ্রেডিং দিয়ে দেয়া হয়, আমাদের এখানেও সেই চর্চাই হওয়া উচিত। সার্টিফিকেশন বোর্ড ঠিক করবে, কোন সিনেমা কোন বয়সের উপযুক্ত। সংবিধানের ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা গেলে খুব ভালো হয়। সিনেমা সেন্সর করতে হবে, এ বিষয়টাই তো ভুল। সেন্সর-প্রথার মাধ্যমে সিনেমাকে আটকে রেখে সিনেমাকে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে এটি যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে তো পারেই না, উল্টো পিছিয়ে দিয়েছে। আগের সেন্সর-প্রথায় ভালো অনেক সিনেমা আটকে আছে। এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এখন যেহেতু মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলছি, এর সঙ্গে সেন্সরের ব্যাপারটাই সাংঘর্ষিক। কাজেই বৈশ্বিক আদর্শ মেনে সার্টিফিকেশন হতে পারে। ছোট-খাটো কারণে চলচ্চিত্র আটকে দেয়া হয়েছে। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র আজও সেন্সর পায়নি। অথচ অনেক নৃশংস ও নারীকে হেয় করা চলচ্চিত্র দিব্যি মুক্তি পেয়েছে এবং মহাসমারোহে হলে চলেছে। ক্রিটিক্যাল কোনো ছবি, যা দর্শককে ভাবায়, সেসব আটকে দেয়া হয়েছে। আগামীতে কোনো নির্মাতাকে তার ছবি নির্মাণের সময় যেন ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ করতে না হয়। আমরা উদার ও শিল্পবোধসম্পন্ন সার্টিফিকেশন বোর্ড চাই। ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিত ভারতবর্ষের মানুষকে নিপীড়নের জন্য এই আইনটা করা হয়েছিল। তখন এর নাম ছিল সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট। এরপর আইনটা প্রথমে পাকিস্তান, তারপর স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন নতুন নামে হাজির হয়েছে মাত্র। কিন্তু এর মৌলিক প্রস্তাবনা বদলায়নি। শিল্প, সাহিত্য আর সিনেমার মাধ্যমে মানুষের যৌথ প্রকাশ তো সমাজের মৌলিক অধিকার। একটি স্বাধীন দেশে তো সেন্সর বোর্ড বলে কিছু থাকার কথাই ছিল না।

পদাধিকারবলে আমলারা কেন ছবির সিদ্ধান্ত নেবেন? এটা তো ভয়াবহ অন্যায়, ২০২৪-এর দ্বিতীয় স্বাধীনতার পর এটা আর চলতে দেয়া যায় না। ছবির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে তাদেরই নেয়া উচিত, যারা শুধু সিনেমার হালহকিকতই নয়, সেই সঙ্গে তাবৎ দুনিয়ার শিল্প-সাহিত্য এবং নিজের চলতি সমাজের পালসটাও বোঝেন। সেন্সর বোর্ডকে নির্মাতা, প্রযোজকের কাছে আতঙ্কের জায়গা হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। তারা চাইলে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ছবি আটকাতে পারত, চাইলে ছেড়ে দিতে পারত। যেসব সিনেমা দেশ ও সার্বভৌমত্বকে আঘাত করে, সেগুলোর বিষয় আলাদা। একটু স্পর্শকাতর বিষয়, সত্য গল্প, যেটার সঙ্গে বাস্তবের মিল আছে, সেই সিনেমা আটকে দেয়া হতো। এর মাধ্যমে পরিচালকদের গলা চেপে ধরে বোঝানো হতো, যা ইচ্ছা ভাবতে পারবেন না। এভাবে যাদের সিনেমা সেন্সর বোর্ডে আটকানো আছে, অনতিবিলম্বে মুক্তি দেয়া হোক। এসব ছবির কোনোটির নির্মাণ শেষ হয় ১৫ বছর আগে। কোনোটি আবার ১০ বছর। তবে দেশে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর এসব ছবির নির্মাতারা আশায় বুক বেঁধেছেন। তাদের সৃষ্ট শিল্পকর্ম যাদের জন্য বানিয়েছেন, তাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারবেন, এমনটাই মনে করছেন। নির্মাণের যাবতীয় কাজ শেষে লম্বা সময় ধরে এভাবে সেন্সর বোর্ডে ছবি আটকে থাকাটা পরিচালকের জন্য হতাশার। সেন্সর বোর্ড ও এফডিসিকে রাজনীতিমুক্ত রাখতে হবে, চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড, এফডিসি, এসব ক্ষেত্রে রাজনীতিমুক্ত লোকজন রাখা উচিত। ভালো ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে এসব প্রয়োজন।

সত্যিকারের সংস্কৃতিমনা লোকজন এখানে থাকা উচিত। যাদের রাজনীতির গন্ধ আছে, তাদের এখানে রাখাই উচিত না। দেশের বাইরের বিভিন্ন উৎসবে পুরস্কৃত ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি বানিয়ে পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর কোনো অন্যায় করেননি। এখন ‘শনিবার বিকেল’ আর আটকে থাকবে না। শুধু ‘শনিবার বিকেল’ নয়, দেশের কোনো ছবিই আটকে থাকবে না। প্রথম কথা হচ্ছে, কোনো ছবিই আটকে রাখা যাবে না। এই যে ছবি আটকানোর সংস্কৃতি, মানুষের মুখ বন্ধ করার সংস্কৃতি, সংবাদমাধ্যমের গলা চেপে ধরার সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র নির্মাতার গলা চেপে ধরার সংস্কৃতি-এসব সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশকে বের হয়ে আসতে হবে। এই পরিবর্তনের জন্যই কিন্তু বিপ্লবগুলো হয়েছে। সেই পরিবর্তন ঘটতে হবে। আমরা নিশ্চিত, সে পরিবর্তন ঘটবে। আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা চাই, আমরা জেলখানায় থাকতে চাই না, এটাই তো এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য যেহেতু এটা, সেহেতু মূল লক্ষ্যের সঙ্গে এই সরকার একমত, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দর্শকদের সেগুলো দেখার সুযোগ করে দেয়া হোক। পরিচালক হিসেবে দর্শককে একটা গল্প বলার অধিকার একজন নির্মাতার আছে। বাংলাদেশে পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে সেন্সর প্রথা গেঁড়ে ছিল। সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশেও সেন্সর বোর্ডের অবসান ঘটল।

সার্টিফিকেশন বোর্ড নিয়ে আলোচনার মধ্যে সার্টিফিকেশন আইনকেও সামনে আনছেন নির্মাতারা, শিল্পীরা। আইনের বেশ কয়েকটি ধারা নিয়ে চলচ্চিত্রকর্মীদের জোরালো আপত্তি থাকা সত্ত্বেও আইনটি করেছিল বিগত সরকার। ‘দ্য সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট, ১৯৬৩’-এর বেশির ভাগ ধারাই সার্টিফিকেশন আইনে রেখে দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও কড়া করা হয়েছে। ফলে সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠিত হয়েছে কেবল নামেই। এর আইন সংশোধন না করা হলে সেন্সরের খড়্গ থেকে ঢাকার চলচ্চিত্রের মুক্তি আর মিলবে না। সার্টিফিকেশন আইনের কোনো ধারা সেন্সর আইনের চেয়েও বেশি ‘দমনমূলক’। সার্টিফিকেশন আইনের সংজ্ঞায় ‘চলচ্চিত্রের’ পরিধি আরও বাড়ানো হয়েছে। সেন্সর আইনে শুধু পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকেই ‘চলচ্চিত্র’ বলা হতো। সার্টিফিকেশন আইনে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পাশাপাশি স্বল্পদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্যচিত্র, কার্টুনচিত্র, অ্যানিমেশন চিত্রসহ সব ধরনের চলচ্চিত্রকেই সার্টিফিকেশন আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সার্টিফিকেশনের ধারণা হলো, এটি চলচ্চিত্র নির্মাতাকে উš§ুক্ত পরিসর দেবে, স্বাধীনতা দেবে। সেন্সর আইনে এই স্বাধীনতা সংকুচিত ছিল, সার্টিফিকেশন আইনে তা-ও কেড়ে নেয়া হয়েছে। আগে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বা প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে সেন্সর বোর্ড খুব মাথা ঘামাত না।

এ আইনে সেগুলোও সরকারি অনুমোদনের আওতায় আনা হলো। সার্টিফিকেশন বোর্ডের ‘অনুমোদন’ ছাড়া কেউ আর তা কোথাও দেখাতে পারবে না। সার্টিফিকেশন আইন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এখন ডিজিটাল মাধ্যমের জন্য নির্মিত চলচ্চিত্রের জন্য সার্টিফিকেশন বোর্ডের অনুমোদন নিতে হবে। অনুমোদন ছাড়া ওটিটি বা কোনো ডিজিটাল মাধ্যমেই ছবি প্রদর্শন করা যাবে না। এর ধারাগুলা এত বিস্তৃত ও মারাত্মক যে যেকোনো ডিজিটাল কনটেন্ট নির্মাতাই এই আইনের আওতায় বন্দি হবেন। সার্টিফিকেশন বোর্ডের কাজ ছবির গ্রেডিং করা, অথচ এই নতুন আইনের সুযোগে বোর্ড এখন ডিজিটাল কনটেন্টেরও ভাগ্যবিধাতা। কোনটা দেখানো যাবে আর কোনটা যাবে না, সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের একক সর্বময় ক্ষমতা এখনো এই বোর্ডের। সার্টিফিকেশন বোর্ডের প্রধান কাজ কখনোই ছবি আটকানো নয়, ছবিটি কোন বয়সের দর্শকেরা দেখতে পারবেন, সেটা নির্ধারণ করা। অথচ সার্টিফিকেশনের নামে সেন্সর আইনকেই আরও কঠোরভাবে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ফলে নির্মাতারা চলচ্চিত্র নির্মাণে আগের স্বাধীনতাও কতটা পাবেন, তা নিয়ে নতুন করে সংশয় তৈরি হয়েছে।

সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠিত হওয়ায় চলচ্চিত্র থেকে ‘সেন্সরের খড়গ’ উঠে যাবে বলে চলচ্চিত্রকর্মীরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, বিদ্যমান আইনে তা পূরণ হওয়ার নয় বলে মনে করছেন তারাই। কারণ সার্টিফিকেশন আইনেও রয়ে গেছে ‘সেন্সরের কাঁচি’। সিনেমা বাতিল বা স্থগিত করার এখতিয়ার রয়েছে নতুন সার্টিফিকেশন বোর্ডের। তাই নয়, কোনো জেলা প্রশাসক চাইলে তার জেলায় সার্টিফিকেট পাওয়া সিনেমার প্রদর্শনও বন্ধ করতে পারবেন বলে সার্টিফিকেশন আইনে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন তো করা হয়েছে গ্রেডিং অনুযায়ী সার্টিফিকেট দেয়ার জন্য। কোনো সিনেমা বাতিল করার জন্য তো নয়। তাহলে সিনেমাকে বাতিল করার ব্যাপারটি কেন রাখা হলো? নতুন আইনে সিনেমাকে বাতিল বা স্থগিত করার যে বিষয়গুলো রয়েছে, তা বিলোপ করে বাধামুক্ত সার্টিফিকেশন আইন চূড়ান্ত করতে হবে। একই সঙ্গে একটা নির্দেশনা বা গাইডলাইন থাকতে পারে, যেখানে রাষ্ট্রের যে মৌলিক নীতি এবং তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যেন সিনেমা বানানো না হয়। সার্টিফিকেশন আইনটি মূলত ‘সার্টিফিকেশন’ নামের ছদ্মবেশে ঔপনিবেশিক সেন্সর আইনেরই নবায়ন মাত্র। এই আইনে চলচ্চিত্র নির্মাণ-প্রদর্শন ব্যবস্থা নতুন কোনো মুক্তি বা স্বাধীনতার স্বাদ পাবে না। কাঠামোগতভাবে আইনটি চলচ্চিত্রের স্বাধীনতার অবাধ পরিসরের কোনো অঙ্গীকার করে না। বরং ঔপনিবেশিক সেন্সর আইনের মতই এই নতুন আইনও চলচ্চিত্রকে ক্ষমতাসীন সরকারের বা স্পষ্ট করে বললে বলা যায, ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের কাছে নতজানু হতে বাধ্য করেছে। ফলে চলচ্চিত্র নির্মাণ-প্রদর্শন কাঠামোর স্বাধীনতা এই আইনে নেই।

সার্টিফিকেশন বোর্ড হয়েছে কেবলমাত্র নামেই, কাঠামোগতভাবে এর সবকিছুই সেন্সর বোর্ডের নামান্তর। এই আইনও আগের সেন্সর আইনের মতই দমনমূলক এবং চলচ্চিত্রের মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রশ্নে নতুন প্রতিবন্ধক। আমরা যে সার্টিফিকেশন আইন চাই, তা এই আইন নয়। এই আইন তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রকে নতুন করে বেঁধে ফেলার জন্য, অথচ সেন্সর থেকে সার্টিফিকেশনে উত্তরণের অর্থ হলো-চলচ্চিত্র মুক্ত হবে। অথচ হয়েছে ঠিক এর উল্টো। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কাউকে বোর্ডের প্রধান করা উচিত ছিল। যদি সত্যিকারের সার্টিফিকেশন বোর্ড হতো, তাহলে বোর্ডের চেযারম্যান করা হতো দেশের চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট কোনো গ্রহণযোগ্য ও সম্মানিত ব্যক্তিকে। বোর্ডের সচিব থাকবেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা। এর বাইরে কেবলমাত্র আইন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা থাকতে পারেন বোর্ডে, আইনগত বিষয়গুলোতে মতামতের দরকারে। এছাড়া বোর্ডের বাকি সব সদস্য হবেন বেসরকারি ব্যক্তিরা। যারা চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন হবেন। আমরা তো সার্টিফিকেশন বোর্ড বলতে এমন কিছু বুঝি। নাম পাল্টালেই জেলখানা যেমন সরাইখানা হয়ে যায় না, তেমনি সেন্সরের জায়গায় সার্টিফিকেশন নাম দিলেই এটা সিনেমাবান্ধব হয়ে যায় না। দিনের শেষে নতুন এই বোর্ডের সব ক্ষমতা আমলাদের হাতেই থেকে গেল। এর আগে সেন্সর বোর্ডে চলচ্চিত্রকর্মীদের তুলনায় সরকারি কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি ছিল। নবগঠিত সার্টিফিকেশন বোর্ডেও সরকারি কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি। সংখ্যায় কম হওয়ার কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারি কর্মকর্তাদের তুলনায় চলচ্চিত্রবোদ্ধারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন না। ভারতে আমলা নন, নির্মাতা, প্রযোজক বা চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদেরই ‘দ্য সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন’ (সিবিএফসি) চেয়ারপারসনের দায়িত্বে থাকেন। ভারতের সার্টিফিকেশন বোর্ডে সচিব হিসেবে রাখা হয় সরকারি কর্মকর্তাকে। চেয়ারম্যান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় শিল্পী, নির্মাতা, প্রযোজকেরা চলচ্চিত্রের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেন। সেন্সর থেকে সার্টিফিকেশনে উত্তরণের যে মর্ম, তা এ আইনে কার্যকর করা সম্ভব হবে না। এ আইনের মূল ভিত্তি এখনো সেন্সর আইন।

সার্টিফিকেশন আইন আসলে ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রভুদের বানানো শতবর্ষ পুরোনো নিপীড়নমূলক আইনের উত্তরাধিকার। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের আইনটি ব্রিটিশদের আইনের চেয়েও নিবর্তনমূলক। সার্টিফিকেশন আইনের প্রয়োজন চলচ্চিত্র নির্মাণ, প্রদর্শন ও চলচ্চিত্র সংস্কৃতিকে উৎসাহিত ও সুরক্ষিত করার জন্য, চলচ্চিত্র-সংস্কৃতিকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য নয়। আমরা চাই, আমাদের সংবিধানে বাক্ ও চিন্তার স্বাধীনতার যে অঙ্গীকার করা হয়েছে, চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন সে আলোকে তৈরি হোক। সিনেমা বা কনটেন্টকে আইনি কাঠামোয় আমলাদের হাত থেকে মুক্ত করে এর অংশীজনের হাতে ছেড়ে দেয়া দরকার।